আজও জ্বলবে। পূর্বে, পশ্চিমে, উত্তরে, হিমালয়ের কোলে গরিবদের গ্রামে, দক্ষিণের সমুদ্রকূলে নারকেলের বনে, ধান আর গমখেতের ফাঁকে ফাঁকে লাখো কুটিরে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা আজও আলোয় আলোয় নক্ষত্রালোক সাজাবে। অমাবস্যার রাত আলোয় হাসবে।
দীপাবলি আসলে বিজয়ীর উৎসব। দীপাবলির ইতিহাসের সঙ্গে পুরাণের যেসব গল্প প্রচলিত রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের অযোধ্যায় ফেরার কাহিনি। এ ছাড়া আরও অনেকগুলো গল্প জড়িয়ে রয়েছে দীপাবলির সঙ্গে। রামায়ণ মতে, একদা এই দিনে অযোধ্যায় আলো জ্বলে, উৎসবে মেতেছিল, কারণ লঙ্কাকাণ্ড সমাধা করে রামচন্দ্র এই দিনেই অযোধ্যায় পৌঁছেছিলেন। শুনে ভারতবর্ষের প্রতিটি সন্তান শান্তির প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন, ঘরে ঘরে কোটি কোটি সীতা আনন্দে আলো জ্বেলেছিলেন। কেউ কেউ বলেন, দীপাবলির আলো জ্বেলে আমরা আসলে নরকাসুরে জয়ের ঘটনা স্মরণ করি। এমনি এক অমাবস্যার রাতেই নাকি শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হয়েছিলেন ত্রিলোকের ত্রাস নরকাসুর। ষোল হাজার বন্দিনী নারী মুক্তি পেয়ে আবার সংসারে ফিরে এসেছিলেন, ঋষিরা আবার দিনের আলো দেখতে পেয়েছিলেন। কলঙ্কমুক্ত পৃথিবী তাই সেদিন আলোয় আলোয় অপরূপা সেজেছিল, মর্ত্যবাসী আনন্দে হেসেছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, ভারতের দরিদ্রতম মানুষটিও অন্ধকার রাতে আলো জ্বেলে একদিন উৎসবে মেতেছিল, কারণ সেই চতুর্দশী সন্ধ্যায়ই সংবাদ এসেছিল, পরাজিত শকেরা পলায়নের পথ খুঁজছে, স্বদেশে রাজা বিক্রমাদিত্য তাদের উৎখাত করতে সমর্থ হয়েছেন। শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল ভারতবর্ষ। এ আলো তারই স্মারক।
আবার অন্য রকম কাহিনিও শোনা যায়। প্রজারঞ্জক রাজা ছিলেন মহাবলী। শক্তিমানও বটে। তার ভয়ে দেবতারাও শঙ্কিত। কিন্তু প্রজারা তাঁকে ভালোবাসে। ভীত দেবতাদের প্রার্থনায় বিষ্ণু বামনবেশে মহাবলীর সামনে এসে হাজির হলেন। মহাবলী জানতে চাইলেন, তিনি কী চান। বামনরূপী বিষ্ণু বললেন, ত্রিপাদ ভূমি। দানশীল মহাবলী তাতে আপত্তি করলেন না। তিনি বামনের প্রার্থনা মঞ্জুর করে বললেন, ‘বেশ, তাই নাও।’ বিষ্ণু এবার স্বরূপ ধারণ করলেন। এক পায়ে তিনি পৃথিবী অধিকার করলেন, আর এক পদক্ষেপে স্বর্গ অধিকৃত হলো। বিষ্ণু বললেন, তৃতীয় পদ কোথায় স্থাপন করি? মহাবলী বললেন, আমার মস্তকে। বিষ্ণুর পদভারে মহাবলী রসাতলে প্রোথিত হলেন।
প্রজারা কান্নাকাটি শুরু করল। তাদের পীড়াপীড়িতে পরে বিষ্ণু প্রতিবছর এক দিনের জন্য মহাবলীকে নিজের রাজধানীতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। সে দিনটিই দীপাবলি বা দেওয়ালি। লোকজন নরপতিকে নিজেদের মধ্যে ফিরে পেয়েছিলেন বলেই প্রজারা সেদিন আলোর উৎসব করেছিল। কেউ কেউ এমনও বলেন, মহামায়া দুর্গা এদিনেই অসুর বধ করে ত্রিলোককে নিশ্চিন্তে আলো জ্বালতে দিয়েছিলেন।
আবার কেউ কেউ বলেন, পিতার ক্রোধে দরিদ্র ব্রাহ্মণের ঘরে বিতাড়িত এক রাজকন্যা বাবার সঙ্গে শর্ত করেছিলেন পুরো রাজ্য এক রাত্রি আলোকহীন রাখতে। বাবার হারিয়ে যাওয়া গজমতির মালা কুড়িয়ে পেয়েছিল তার এই দুঃখিনী মেয়ে, মালা ফেরত দেওয়ার আগে শর্ত দিয়েছিল সে কৃষ্ণ-চতুর্দশীতে রাজ্য আলোহীন রাখতে হবে। তাই হলো। রাজার আদেশে গোটা রাজ্যে সেদিন কারোর ঘরে আলো নেই। আলো জ্বলছে, কেবল সেই রাজকন্যার কুটিরেই। সেই থেকে দীপাবলির রাতে ঘরে ঘরে আলো জ্বলে।
আবার ঐতিহাসিক কাহিনি মতে, রাজা বিক্রমাদিত্য (দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত) শক দস্যুরাজকে পরাজিত করে পরিচিত হন শকারি নামে। এই জয়লাভ তার রাজত্বকালে মহাসমারোহে পালিত হতো আলো উৎসব তথা দীপাবলি (দীপমালা) উৎসব হিসেবে। এ ছাড়া মহাভারতে পাওয়া যায় যে বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাসের পর দীপাবলিতেই হস্তিনাপুরে ফিরে এসেছিলেন পাণ্ডবেরা। সে জন্য আলোর মালায় সাজানো হয়েছিল গোটা হস্তিনাপুর।
দীপাবলি, শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নয়, শিখ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদেরও অনুষ্ঠান। জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীর ৫২৭ অব্দে দীপাবলির দিনে মোক্ষ (নির্বাণ) লাভ করেন। দীপাবলির দিনে শিখ ধর্মগুরু গুরু হরগোবিন্দ অমৃতসরে ফিরে আসেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করে গোয়ালিওর দুর্গ থেকে বায়ান্ন হিন্দু রাজাকে মুক্ত করে, তার এই প্রত্যাবর্তনকে শিখেরা পালন করেন। তাঁরা এ দিনকে ‘বন্দী ছোড় দিবস’ও বলেন।
দীপাবলি অমাবস্যার রাতে পালন করা হয়। তাই চারদিকে নিকষ অন্ধকার থাকে আর এই অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সর্বত্র প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করে রাখে। বিশ্বাস করা হয়, নিকষ অন্ধকারেই অশুভ আত্মা ও অশুভ শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই এই অশুভ শক্তিকে দুর্বল করতে ঘরের প্রতিটি কোনায় বাতি বা প্রদীপ জ্বালানো হয়ে থাকে। আলোর উৎসব দীপাবলি কোথাও বিজয় উৎসব, কোথাও নববর্ষের উৎসব, কোথাও এদিনে লক্ষ্মীপূজা। কোথাও পূর্বপুরুষের স্মৃতিতর্পণ।
আমাদের দেশে এই দীপাবলির রাতেই কালীপূজা। অমাবস্যার অন্ধকারে দিনটি যেন আলোর গরিমাই ঘোষণা করে। দীপাবলি যেন অশুভ অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর সাধনা! আনন্দের উৎসব মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর জয়কে উদ্যাপন করা। আলোকসজ্জার এই দিবস অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো জ্বালার দিন। নিজের ভেতরের বাইরের সব অজ্ঞতা ও তমকে দীপশিখায় বিদূরিত করার দিন। প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার চিরন্তন শিখা প্রজ্বালিত করার দিন। দেশ থেকে দেশে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে—এই দিনের মাহাত্ম্য ভিন্ন ভিন্ন; তবু মূল কথা এক। আর আধ্যাত্মিকতার গভীর দর্শনে এই দিন, আত্মাকে প্রজ্বালিত করে পরিশুদ্ধ করে মোক্ষ লাভেরও দিন।