‘কেননা আমাদের জন্য একটি শিশু জন্ম নিয়েছেন, তাঁকে ডাকা হবে অনন্য পরিকল্পক, পরাক্রমী ঈশ্বর, শাশ্বত জন্মদাতা, শান্তিরাজ, এমন সব নামে (ইসাইয়া ৯: ৬)।’
বিশ্বের কোটি কোটি খ্রিষ্টান ২৫ ডিসেম্বর মহাসমারোহে ক্রিসমাস অর্থাৎ বড়দিন পার্বণ উদ্যাপন করেন।
আজ থেকে ২ হাজার ২৪ বছর আগে ঈশ্বরতনয় আশ্চর্যজনকভাবে ঐশ শক্তিতে মেরির কোলে বেথলেহেমের জীর্ণ গোশালায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ইহুদি জাতি যুগ যুগ ধরে মুক্তিদাতা মসিহর জন্য অপেক্ষা করছিল। আগের নবীরা তাঁর আসার কথা ঘোষণা করেছেন, তাঁদের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। হৃদয়-মন পরিবর্তন করে সৎ, পবিত্র ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবন এবং অন্যের কল্যাণ ও দরিদ্রদের প্রতি দয়া করার আহ্বান জানিয়েছেন।
সময় পূর্ণ হলে মানবজাতির প্রতীক্ষিত মুক্তিদাতা প্রভু যিশু ৩০ বছর বয়সে প্রকাশ্যে আসেন এবং প্রচারকার্য শুরু করেন। বাণী প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই চারদিকে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অনেক লোক তাঁর অমৃতময় বাণী শোনার জন্য তাঁর চারপাশে ভিড় জমায়। শ্রোতাদের তিনি মন পরিবর্তনের আহ্বান জানান।
পাপ, অসত্য ও অন্যায় থেকে মন ফিরিয়ে সত্য, সুন্দর ও ভালো কাজে মনোনিবেশ করার আহ্বান জানান যিশু। তিনি শিক্ষা দেন—আমরা যাতে পাপকে ঘৃণা করি, পাপীকে নয়। তিনি অবহেলিত, নিপীড়িত ও অস্পৃশ্যদের পক্ষ অবলম্বন করেন। তিনি বলতেন, অসুস্থ মানুষের জন্য চিকিৎসক প্রয়োজন; সুস্থ মানুষের জন্য নয়। পৃথিবীতে থাকাকালে তিনি অনেক আশ্চর্য কাজ করেছেন—অন্ধকে দিয়েছেন দৃষ্টি, কালাকে দিয়েছেন শোনার ক্ষমতা, প্রতিবন্ধীকে দিয়েছেন হাঁটার শক্তি, এমনকি মৃত ব্যক্তিকে দিয়েছেন জীবন। তিনি একে অন্যকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে শিক্ষা দেন। শুধু পাড়াপ্রতিবেশী ও বন্ধুদেরই নয়, এমনকি শক্রদেরও তিনি ভালোবাসতে বলেন। তিনি একে অপরকে ক্ষমা করার শিক্ষা দেন।
যিশু বলেছেন, তিনি সেবা পেতে নয়, সেবা করতে এ জগতে এসেছেন। অন্যকে সেবা করার মধ্য দিয়েই আমরা মুক্তি ও পরিত্রাণ লাভ করি। প্রতিবেশী ভাইবোনদের, বিশেষ করে ক্ষুধার্তকে অন্নদান, তৃষ্ণার্তকে জল, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র, অসুস্থ মানুষের সেবা, অসহায় ও গরিব–দুঃখী মানুষকেও যখন সেবা করি, তখন তিনিই সেই সেবা গ্রহণ করেন।
যিশুর কাছে ব্যক্তির স্থান ছিল অনেক ঊর্ধ্বে। কারণ, ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সে সৃষ্ট। তাই তো তিনি ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষকে স্থান দিয়েছেন। ধর্মের জন্য মানুষ নয়, বরং মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য ধর্ম।
এ বছর অক্টোবর মাসে বিশ্ব ক্যাথলিক চার্চের বিশপরা পোপ ফ্রান্সিসের উপস্থিতিতে ভ্যাটিকানে এক মাসের সিনডের দ্বিতীয় ও শেষ সম্মেলন করেছেন। এখানে বিশ্ব ক্যাথলিক চার্চের ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ক্যাথলিক চার্চ হলো মানবমুক্তি এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বিশ্বে একতার দৃশ্যমান চিহ্ন। চার্চ সব মানবজাতির মধ্যে একটা সেতুবন্ধ স্থাপন করতে আগ্রহী। ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা ও একতার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে গভীর ইচ্ছা প্রকাশ করে। এই একতা স্থাপনের জন্য একসঙ্গে সবাইকে চলতে হবে। একে অপরের কথা শুনতে হবে। নারীদের মর্যাদার কথা বলা হয়েছে—প্রত্যেক নর-নারী ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট। তাই নারী-পুরুষের মধ্যে সমমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নারী-পুরুষের মধ্যে সব বৈষম্য দূর করতে হবে।
এ বছর আমরা যখন বড়দিন উদ্যাপন করছি, তখন যিশুর জন্মস্থান, পুণ্যভূমিতে চলছে যুদ্ধ—ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে, সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অনেক দেশ জড়িত হয়ে পড়েছে।
শান্তিরাজ প্রভু যিশুখ্রিষ্টের আগমনে এ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। ছাত্র-জনতা আমাদের নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
আমরা প্রার্থনা ও প্রত্যাশা করি, এ দেশ হয়ে উঠুক গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও উন্নত একটা দেশ। প্রভু যিশুর আগমনে সবার জীবন ভরে উঠুক নির্মল আনন্দ, অনাবিল সুখ ও শান্তিতে।
সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, শুভ বড়দিন।
আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ
ঢাকার আর্চবিশপ ও সভাপতি,
বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনী