রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার
রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার

রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার

চেয়ারে অন্য রকম সত্যপ্রিয় মহাথের

কক্সবাজার শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রম্যভূমি পরিচয়ে খ্যাত রামুর অবস্থান। সেখানে মেরংলোয়া গ্রামে ঐতিহ্যবাহী রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার। দৃষ্টিনন্দন তিনতলা বিহারের নিচতলায় বসে দর্শনার্থীদের মিলনমেলা।

সত্যপ্রিয় মহাথের এই প্রতিকৃতি

ভক্তদের কয়েকজন বললেন, সত্যপ্রিয় মহাথের এই প্রতিকৃতি যেন আরও সুন্দর। সত্যপ্রিয় মহাথের গত হয়ে গিয়ে যেন হয়ে উঠেছেন আরও বেশি প্রভাবসঞ্চারী।
গত বছরের ৪ অক্টোবর ছিল সত্যপ্রিয় মহাথেরের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। দিবসটি ঘিরে ১ অক্টোবর বিহার প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় স্মরণসভা। বৌদ্ধসম্প্রদায়ের হাজারো নারী-পুরুষ সমবেত হয়ে সত্যপ্রিয়কে স্মরণ করেছিলেন।

বিহারের নিচতলার এক কোণে চন্দন ও সেগুন কাঠের তৈরি দৃষ্টিনন্দন একটি চেয়ারে বসতেন বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ ধর্মীয়গুরু সত্যপ্রিয় মহাথের। পূজারীরা এসে তাঁর কাছে দীক্ষা নিতেন, দিতেন নানা উপদেশ-পরামর্শ। চেয়ারটি উপহার দিয়েছিল মিয়ানমার সরকার।

২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর দিবাগত রাত ১২টা ৫০ মিনিটে ঢাকা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সত্যপ্রিয় মহাথেরের তিরোধান হয়। ৪ অক্টোবর তাঁর শবদেহ রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারে আনা হয়। পরে ৯ অক্টোবর ধর্মীয় মর্যাদায় পেটিকাবদ্ধ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর শবদেহ সংরক্ষণ করা হয়।
২০২০ সালের ২৭, ২৮ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি তিন দিন ধরে তাঁর জাতীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

সত্যপ্রিয় মহাথের প্রতিকৃতি

বিহারের ভিক্ষুরা জানান, মৃত্যুর পর চেয়ারটি খালি পড়ে ছিল। এই চেয়ারের পাশে সোনালি রঙের শ্বেতপাথরের বুদ্ধমূর্তি। ২০১২ সালে রামু হামলার পর মিয়ানমার সরকার ১৯টি নতুন বিহারের জন্য এ রকম ১৯টি শ্বেতপাথরের বুদ্ধমূর্তি উপহার হিসেবে পাঠায়। ভক্তরা বিহারে এসে শ্বেতপাথরের বুদ্ধমূর্তিতে পূজার সময় সত্যপ্রিয় মহাথের খালি চেয়ারটি দেখে বিষণ্ন হতেন। তাঁদের মনোবেদনা দূর করতে এটি স্থাপন করেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী রতন বড়ুয়া চৌধুরী। তিনিও সত্যপ্রিয় মহাথেরের ভক্ত ছিলেন।

সেখানকার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে পাথরখচিত সোনালি রঙের চন্দনকাঠের দৃষ্টিনন্দন একটি চেয়ার। চেয়ারে বসে আছেন বৌদ্ধসম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু, সমাজসেবায় একুশে পদকপ্রাপ্ত পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের। তাঁর হাতে ঐতিহ্যবাহী পাখা, সামনে ও পাশে ফুলের সমাহার। চশমা পরা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি চেয়ে আছেন দূরের পানে; ভক্তদের আগমনী ফটকের দিকে। ভক্তরা আসছেন, পায়ের আনত হয়ে পূজা দিচ্ছেন, জানাচ্ছেন অন্তরতম শ্রদ্ধা।

এই যাঁকে তাঁরা স্মরণ করছেন, পূজার মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, তিনি শারীরিকভাবে আর নেই। এটি সত্যপ্রিয় মহাথেরের অবিকল প্রতিকৃতি। দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি মানুষেরই হাতে গড়া।

মিয়ানমারের একজন কারুশিল্পীকে দিয়ে এই প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়। সত্যপ্রিয় মহাথের যেভাবে এই চেয়ারে বসতেন, অবিকল সেভাবেই প্রতিকৃতিটি স্থাপন করা হয়েছে। দূর থেকে বোঝার উপায় নেই, আসল না নকল। প্রতিকৃতির উচ্চতা চার ফুট, প্রস্থ আড়াই ফুট।

সীমা মহাবিহারের আবাসিক পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বললেন, পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের বৌদ্ধ সম্প্রদায়সহ সব ধর্মের মানুষের কাছেই পরম শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাঁর প্রতিকৃতিতে মোম, সিমেন্ট, প্লাস্টিকের বদলে বিশেষ ধাতু ব্যবহার হয়েছে। সত্যপ্রিয় মহাথেরের প্রতিকৃতি দেখে দর্শনার্থীরা প্রশান্তি লাভ করছেন। খুঁজে পাচ্ছেন মনের সান্ত্বনা।

সত্যপ্রিয় মহাথের একুশে পদক গ্রহন করছেন

বিহারের আবাসিক পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বললেন, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় এলাকায় মানুষ মানত করে বিহারে এসে বুদ্ধের উপাসনা করেন। প্রবারণা পূর্ণিমাতে ভক্তদের সংখ্যা বেড়ে যায় শতগুণ। সবাই জড়ো হন প্রিয় ভিক্ষু সত্যপ্রিয় মহাথের বন্দনায়।
পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের বেশ কিছু মূল্যবান ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর শেষ অনুবাদ করা বই বিনয় পিটকের অন্তর্গত চুল্লবর্গ। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বৌদ্ধধর্মের উচ্চতর শিক্ষায় বইটি ব্যবহৃত হচ্ছে। সত্যপ্রিয় মহাথের যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তাঁর নামে বিহারের তৃতীয় তলায় প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে ৩০ হাজার বই রাখার উপযোগী ‘সত্যপ্রিয় পাঠাগার’ তৈরি করা হয়।