আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে অগণিত নিয়ামত দান করেছেন। এসব নিয়ামতের মধ্যে সুসন্তান অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের যুগল হতে তোমাদের জন্য পুত্র ও পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের উত্তম জীবনোপকরণ দিয়েছেন।’ (সুরা-১৬ নাহল, আয়াত: ৭২)।
শিশু মানবজাতির অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিশুরা নিষ্পাপ, শিশু পবিত্রতার প্রতীক। শৈশবেই মানুষের জীবনের গতিপথ নির্ধারিত হয়। তাই ইসলাম শৈশবকালকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে শিশু শব্দের সমার্থক আরবি চারটি শব্দ মোট ৭৫ বার উল্লেখ হয়েছে। যথা: ‘তিফল’ (শিশু, বালক), ‘ছবিয়্য’ (শিশু, কিশোর), ‘গুলাম’ (শিশু, তরুণ) ও ‘ওয়ালাদ’ (শিশু, বত্স, সন্তান। ‘তিফল’ শব্দটি পবিত্র কোরআনে আছে তিনবার। এর বহুবচন ‘আতফাল’ আছে একবার। ‘ছবিয়্য’ শব্দটি কোরআনে আছে দুবার। ‘গুলাম’ শব্দটি আছে ১২ বার। এর দ্বিবচন ‘গুলামান’ কর্মকারকরূপে ‘গুলামাঈন’ আছে একবার (১৮: ৮২। বহুবচনে ‘গিলমান’ আছে একবার। ‘ওয়ালাদ’ শব্দটি পবিত্র কোরআনে আছে ৩৩ বার। এর বহুবচন ‘আওলাদ’ শব্দটি রয়েছে ২২ বার।
প্রিয় নবী হজরত (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক শিশুই স্বভাবধর্মে (ইসলামে) জন্মগ্রহণ করে।’ (তিরমিজি)। হজরত আবু রাফি (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে দেখেছি, হজরত হাসান (রা.)-এর জন্ম হলে তিনি তাঁর কানে নামাজের আজানের মতো আজান দিয়েছিলেন। (তিরমিজি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৮৩)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হজরত হাসান (রা.)-এর জন্মের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ডান কানে আজান ও বাঁ কানে ইকামাত দিয়েছিলেন। (বায়হাকি)।
শিশুর সুন্দর নাম রাখা:
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, পিতার ওপর নবজাতকের হক (অধিকার) হলো তার জন্য সুন্দর নাম রাখা। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় নাম হলো ‘আবদুল্লাহ’ ও আবদুর রহমান’। (কানজুল উম্মাল, খণ্ড: ১৬, পৃষ্ঠা: ৪১৭)।
হজরত আবু রাফি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা কারও নাম ‘মুহাম্মাদ’ রাখলে তাকে মারধর করবে না এবং তাকে অসম্মান করবে না।
(কানজুল উম্মাল, খণ্ড: ১৬, পৃষ্ঠা: ৪১৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যার তিন তিনটি সন্তান জন্মগ্রহণ করল, অথচ সে কারও নাম ‘মুহাম্মাদ’ রাখল না, সে জাহিল (মূর্খ) সুলভ আচরণ করল। (কানজুল উম্মাল, খণ্ড: ১৬, পৃষ্ঠা: ৪১৯)।
আমরা শিশুদের নানান আদুরে শব্দে ডাকি, এটি সুন্নতে নববি। রাসুলে করিম (সা.) হজরত আয়িশা (রা.)কে শৈশবে ‘হুমায়রা’ (বণ্য) নামে ডাকতেন। (মুসলিম)।
মদিনায় হিজরতের পর প্রথম এক সাহাবির সন্তান হলে সব সাহাবি আনন্দ উৎসব করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।
শিশুকে কোলে নেওয়া সুন্নত:
মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) শিশুদের কোলে নিতেন। একবার এক সাহাবির সন্তানকে কোলে নিলে শিশুটি তাঁর কোলে প্রস্রাব করে দেয়। তবে এতে তিনি বিরক্ত হননি।
শিশুকে আদর–স্নেহ করা:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ছোটদের স্নেহ করে না, সে আমার উম্মত না।’ (আবুদাউদ ও তিরমিজি)। হজরত আনাস (রা.) বলেন, এক গরিব মহিলা তাঁর দুই কন্যাসন্তান নিয়ে হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.)-এর কাছে এলে তিনি তাঁকে তিনটি খেজুর দিলেন। মহিলাটি তাঁর দুই কন্যাকে দুটি খেজুর দিলেন এবং একটি নিজে খাওয়ার জন্য মুখে তুলে নিচ্ছিলেন, এ সময় শিশুরা সেটি খেতে চাইলে মহিলা ওই খেজুরটি দুই ভাগ করে তাদের হাতে তুলে দিলেন। আয়িশা (রা.) বলেন, মহিলার এই কাজে আমি অভিভূত হলাম, তাই আমি ঘটনাটি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বললাম। তিনি বললেন, আয়িশা! আল্লাহ তাআলা এই মহিলাকে এর বিনিময়ে জান্নাত দান করবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। (মুসলিম, রিয়াদুস সালিহিন, পৃষ্ঠা: ১৩৮-১৩৯)।
শিশুকে চুম্বন করা:
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার এক ব্যক্তি একটি শিশুকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে এলেন এবং শিশুটিকে চুমু দিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ দৃশ্য দেখে বললেন, শিশুটির প্রতি কি তোমার ভালোবাসার উদ্রেক হয়েছে? লোকটি বলল, জি হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমার প্রতি এর চেয়েও বেশি দয়া করবেন। {আদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারি (রা.)}। হযরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, এক বেদুইন ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে এসে বললেন, আপনি কি শিশুদের চুমু দেন? আমি তো কখনো শিশুদের চুমু দিই না। তিনি তাকে বললেন, আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়া ছিনিয়ে নেন, তবে আমার কীই-বা করার আছে? (বুখারি ও মুসলিম, মিশকাত, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪২১)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত হাসান (রা.)কে চুমু দিলেন, তখন সেখানে আকরা ইবনে হাবিস (রা.) উপস্থিত ছিলেন। এ দেখে তিনি বললেন, আমার ১০টি সন্তান আছে, আমি কখনো তাদের চুমু দিইনি। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যে দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হয় না। (বুখারি ও মুসলিম, রিয়াদুস সালিহীন, পৃষ্ঠা: ১২০)।
শিশুর মুখে প্রথম কথা:
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা তোমাদের শিশুদের সর্বপ্রথম কথা শেখাবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ (আল্লাহ ছাড়া মাবুদ নেই)। (বায়হাকি ও মুসতাদরাকে হাকিম)।
শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার:
ইসলামে শিশু হত্যা নিষিদ্ধ। তা দারিদ্র্যের ভয় বা পারিবারিক সুনাম–সম্মান রক্ষা অথবা যেকোনো কারণেই হোক না কেন। জাহেলি যুগে আরব দেশে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। এ ধরনের অমানবিক প্রথাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না। আমি তোমাদের এবং তাদের রিজিক দিয়ে থাকি।’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৫১)। আরও বলা হয়েছে, ‘দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা কোরো না। তাদের এবং তোমাদের আমিই রিজিক দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদের হত্যা করা মহাপাপ।’ (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ৩১)।
শিশু হত্যার পরিণতি:
জাহেলি যুগে শিশুদের হত্যা করা হতো, বিশেষ করে কন্যাশিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। ইসলাম নারী, কন্যাসন্তান ও শিশুর সুরক্ষায় বিধান করে দিয়েছে যে যুদ্ধের সময়ও এদের ওপর আক্রমণ করা যাবে না। পবিত্র কোরআনে রয়েছে, রোজ কিয়ামতে আল্লাহ এর কৈফিয়ত তলব করবেন: ‘যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?’ (সুরা-৮১ তাকভির, আয়াত: ৮-৯)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্ববান এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। প্রতিটি মানুষ তার পরিবার রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে দায়িত্ববান; তাকে এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর সম্পদ ও সন্তানের ব্যাপারে দায়িত্ববান; সে এসবের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (বুখারি ও মুসলিম, মিশকাত, পৃষ্ঠা: ৩২০)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com