ব্যস্ত জীবন। রাজধানীর মানুষ, চাকরি, সংসার, টানাপোড়েন। আকাশছোঁয়া ভবনের ঠাসবুননি ফ্ল্যাটের একটাতে বিচ্ছিন্ন বসবাস। এলিভেটরের আঁটসাঁট অন্ধকূপে প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিথ্যে হাসি বিনিময়। শরীরে চিনি। নির্জন লম্বা করিডরে প্রায় সন্ধ্যায় বাধ্য হয়ে হাঁটতে হয়। দক্ষিণের শেষ মাথার ফ্ল্যাটে নতুন প্রতিবেশী এসেছে। দরজার পাশ দিয়ে ঘুরে আসার সময় থমকে দাঁড়ালাম। ধূপের গন্ধ আসছে। ঘ্রাণের শক্তি যেন আলোর গতির চেয়েও দ্রুতগামী। এক পলকে পৌঁছে দিল আমার শৈশবে, কৈশোরে।
শৈশবে কুণ্ডুবাড়ির মেয়েরা ছিল আমাদের বন্ধু। পারিবারিকভাবে ওদের বাড়িতে দুর্গাপূজা হতো। চারদিকে উৎসবের কাড়া-নাকাড়া। দালানের মোটা থামের ছায়ায় বসে কেউ কেউ কলার পাতায় নারকেল কুরে ছোট ছোট টিলা বানিয়ে ফেলত। ছায়া সরে গেলে হেঁশেলের সামনে খোলা চাতালে নাড়ু-মুড়ি তৈরি হতো দেদার। কাকিমা বলতেন, ‘হাত লাগা, হাত লাগা, ঠান্ডা হয়ে গেলে নাড় বাঁধবে না’। কাকিমার এক বিধবা ননদ কেবল একটু ছোঁয়া বাঁচাতে চাইতেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমাদের ফ্রকের কোঁচড়ে নাড়ু-মুড়ি ভরে দিত বন্ধুরা। আমরা সন্ধ্যা অবধি ঠাকুর বানানো দেখতাম। রাধা বলত, ‘চল, আমরা নারকেলের মালায় ভরে নাড় আর মুড়ি রেখে আসি মায়ের পায়ের কাছে।’ ‘কেন রে?’ ‘ওমা! জানিস না, মা রাতে বেদী থেকে নেমে এসে লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশকে খাওয়াবে’। ‘মা খাবে না?’ ‘মা’রা কি খায়? মা শুধু খাওয়ায়।’
তাই তো। আমাদের মায়েরা কখন খায় তা কি আমরা দেখতে পাই?
মাড়োয়ারিদের মোটা অঙ্কের চাঁদাতেই কালিদাসপুরের দুর্গাপূজার বাড়বাড়ন্ত ছিল। এখন তাঁরা নেই, ব্যবসা গুটিয়ে ভারতে চলে গেছে। একবার আমরা শুনেছিলাম দেবীর ত্রিশূলের ডগা সোনা দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন ভগমান আগরওয়াল। যোগেশ পালের ছোট ছেলে হরেকেষ্ট পাল পূজার সময়ে মূর্তি গড়ত আর শীতকালে যাত্রাপালায় রাজপুত্রের ভূমিকায় অভিনয় করত। হরেকেষ্ট কালিদাসপুরের কিশোরীদের নায়ক ছিল। সে খালি গায়ে ধুতি কোঁচা মেরে মূর্তি গড়ত আর তার ভক্ত দর্শকেরা দেখত তাদের আটপৌরে রাজপুত্রকে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাজাকাররা ওদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আমার চাচির সই ছিল হরেকেষ্টর মা। চাচি টানা ২৫ দিন তাঁকে বাড়িতে লুকিয়ে রেখে এক রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পার করার ব্যবস্থা করে। অনেকে বলে, হরেকেষ্ট ভারতে পালিয়ে যায়নি। ভিনগাঁয়ে এক যাত্রাপালার মঞ্চের অদূরে ঝোপের মধ্যে রাজপুত্রের পোশাক গায়ে তাঁকে মৃত পাওয়া যায়। কিশোরীরা আড়ালে চোখ মোছে।
ধূপের গন্ধে তাড়িত হয়ে দুই বছর আগে আমি আবার গিয়েছিলাম কালিদাসপুরে। পালপাড়ার রাস্তায় ঢোকার আগেই ঢাকের শব্দ কানে এল। নাকে এল পাঁপড় ভাজার গন্ধ। গুড়ের জিলিপি। সব ছাপিয়ে ধূপের গন্ধ। আরতি চলছে। মণ্ডপের বেড়ায় গা লাগিয়ে দাঁড়ালাম। ছোটবেলায় সবকিছু বড় মনে হতো, বড়বেলায় তা ছোট মনে হয়। কিন্তু আসলেই আকারে অনেক ছোট এখনকার মূর্তি, নেই আড়ম্বর। ভালো লাগল মাথায় হিজাব দিয়েও স্কুলের মেয়েরা পূজা দেখতে এসেছে, নাকে এসে লাগছে ধূপের গন্ধ। কিন্তু ‘বাঁশি কই আগের মতো বাজে না, মন আমার এমন কেন সাজে না’। ছোটবেলায় বন্ধু রাধা বলত, ‘দেখবি, দশমীর দিন মা দুর্গার চোখে জল।’
সেদিন ছিল অষ্টমী। তবু আমি দেবীর চোখে জল চিকচিক করতে দেখলাম। কত দিন হয় আমরা শিকড়ছাড়া। যতই বড় হই, মায়ের কাছে আমরা সেই ছোট্টটি। মা, গ্রাম, মাটি—এসব ছেড়ে ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় বন্দী সন্তানদের করুণ মুখ দেখে মা কি না কেঁদে পারেন?
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।