ধর্ম

মানুষের অপরাধপ্রবণতা ও নিষ্ঠুরতা

ধর্ম
ধর্ম

সভ্য সমাজে কোমলমতি শিশু ও অসহায় নারী নির্যাতনসহ তুচ্ছ কারণে খুনখারাবি, নৃশংসতা, বর্বরতা ও নির্মমতার ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে! সমাজজীবনে মানুষ কেন এমন জঘন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে, কেন পশুর মতো এতটা হিংস্র ও নৃশংস হয়ে উঠছে? কেনই-বা মানুষ নিজের ‘মান’ আর ‘হুঁশ’ হারিয়ে অমানুষ হয়ে যায়? মানবাধিকার ও সমাজকর্মী, অপরাধ বিশ্লেষক, মনোবিজ্ঞানী, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এসব নৃশংসতার জন্য দোষী ব্যক্তিদের যথাসময়ে বিচারের মুখোমুখি করতে না পারাকে দায়ী করছেন; একই সঙ্গে তাঁরা ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়কেও দোষারোপ করছেন। যদিও সীমা লঙ্ঘনকারী মানুষকে সাবধান করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের পূর্বে বহু মানবগোষ্ঠীকে আমি ধ্বংস করেছি, যখন তারা সীমা অতিক্রম করেছিল। স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের কাছে তাদের রাসুল এসেছিল, কিন্তু তারা বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এভাবে আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি।’ (সূরা ইউনুস, আয়াত: ১৩)
মুসলমানদের পাড়াপ্রতিবেশী ও স্বজন-পরিজনের মধ্যে পারিবারিক আত্মীয়তার সুদৃঢ় বন্ধনের অভাব, সামাজিক সম্পর্কের শিথিলতা, মানুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং মায়া-মমতা-স্নেহ-ভালোবাসা পর্যাপ্ত না থাকায় সামাজিক অনাচার ও অন্যায়-অপরাধ প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে। আইনকানুন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করার সংস্কৃতি বিরাজ করছে সর্বত্র। একই সঙ্গে অর্থ-সম্পদের প্রতি লোভ-লালসা ও মোহের প্রবণতা বাড়াও যেকোনো ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের অন্যতম কারণ। পরিবারে একটি মানুষ কেন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে পরিবারপ্রধানকে দৃষ্টি দিতে হবে। মূলত, একজন মানুষের আচরণের ক্ষেত্রগুলো পরিবার নির্ধারণ করে দেয়। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ আইন নয়, বিবেক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। এ জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রের শিক্ষার মধ্যে নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। রাসুলুল্লাহ (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে উত্তম কিছুই পিতা-মাতা সন্তানদের দান করতে পারে না।’ (তিরমিজি)
মানুষের অপরাধপ্রবণতা ও নিষ্ঠুরতা সমাজে আগেও ছিল। এখন এর ভিন্ন আকারের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। মানুষের পাশবিকতার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, তা এক দিনে তৈরি হয়নি। আগে কোনো অপরাধ করলে সমাজে জবাবদিহি করতে হতো। এখন কোথাও তা করতে হয় না। অন্যায়-অপরাধ করে দিনের পর দিন অপরাধীরা অনায়াসে পার পেয়ে যায়। এতে মানুষের মধ্যে ভীষণ হতাশা তৈরি হয়। একজন নিরাশ মানুষ নিজের হতাশাকে কাটাতে, নিজের অপ্রাপ্তিবোধের তাড়না থেকে নিজের চেয়ে দুর্বল কাউকে বেছে নিয়ে তার ওপর হিংস্রতা দেখিয়ে একধরনের মানসিক পরিপূর্ণতা লাভ করতে চায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। পক্ষান্তরে মানুষ যখন দেখবে, অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না, তখন অন্যায় পথে পা বাড়াতে সাহস পাবে না। তখন সমাজে অপরাধ করার প্রবণতা কমে আসবে। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো অপরাধীর প্রতি মায়া-মমতা এবং সহানুভূতি যেন আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সুবিচার করতে বাধা প্রদান না করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যখন (বিচারে) তোমরা কথা বলো, তখন ন্যায্য বলবে; যদিও (বিচারাধীন ব্যক্তি) নিকট-আত্মীয় হয়।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত: ১৫২)

>সমাজের বেশির ভাগ মানুষ আইন নয়, বিবেক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। এ জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রের শিক্ষার মধ্যে নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার

আদিম যুগ থেকেই মানুষের মধ্যে নৃশংসতা ও বর্বরতা ছিল। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস চালানো হয়। যদিও মানুষ সভ্যতার মুখোশ পরে আছে। মানুষের অমানবিক আচরণগুলো মূলত তার পাশবিক প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ। জন্মগত পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো পারিপার্শ্বিকতার কারণে জাগ্রত হয়। কমবেশি পশুত্ব স্বভাব প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে। জাতি-গোষ্ঠী, শ্রেণি-লিঙ্গ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, না পাওয়ার অতৃপ্তি ও ঘৃণা মানুষের স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তিকে বাধাগ্রস্ত করে। যেসব নিষ্ঠুর আচরণ ও বদস্বভাব মানুষকে হীন, নীচ ও নিন্দনীয় করে তোলে, তাকে ‘আখলাকে জামিমা’ বা নিন্দনীয় আচরণ বলে। অমানবিক আচরণ মানবজীবনে যেমন নিন্দনীয়, আল্লাহ ও রাসুলের কাছেও তা অত্যন্ত অপছন্দনীয় এবং কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার স্বভাব-চরিত্র কলুষিত হয়, সে মানুষের মর্যাদা হারিয়ে পশুত্বের পর্যায়ে নেমে আসে। পক্ষান্তরে সুন্দর স্বভাব-চরিত্রই হচ্ছে সৎ কর্মের চালিকাশক্তি। তাই মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম চরিত্রকে পরিপূর্ণতা দানের জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি।’ (ইবনে মাজা)
অথচ ধর্ম-কর্ম ভুলে ক্ষুদ্র, তুচ্ছ কারণে সমাজে যত বীভৎস ঘটনা ঘটছে, কয়েক বছর আগে তা ছিল না। এ ব্যাপারে বর্তমানে গণমাধ্যম অনেক সোচ্চার বলে ঘটনাগুলো বেশি আলোচিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত আর সামষ্টিক মূল্যবোধের মধ্যে সংঘাত সব সময় রয়েছে। প্রতিটি বীভৎস ঘটনাকে তাই আলাদাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যাদের মধ্যে ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ কম, তাদের এই বার্তা দিতে হবে, অপরাধ করলে ইহকাল ও পরকালে সাজা নিশ্চিত। এ ধরনের ঘটনায় দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক পার্থিব শাস্তি দেওয়া সম্ভব হলেই এসব অপরাধ কিছুটা হলেও কমে আসবে। যাঁরা বিভিন্নভাবে সমাজের নানা ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছেন, তাঁদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
মুসলিম পরিবারের পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা, বিচারহীনতা, বিচার-প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার সংস্কৃতি অমানবিক ও বীভৎস ঘটনার অন্যতম কারণ। ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইসলামের সাংস্কৃতিক বিকাশ জাগ্রত করে মানবাধিকার সুরক্ষার প্রতি আরও সংবেদনশীল হতে পারলে সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ ছাড়া ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি এমন আস্থা তৈরি করতে হবে, যাতে জনগণ তাদের ওপর ভরসা রাখতে পারে। সমাজে কোনো অন্যায়-অপরাধ হতে দেখলে মানুষ দলগত প্রতিরোধ করবে, সে ধরনের প্রতিবাদমূলক মনোভাবও কমে যাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জুমার নামাজের খুতবায় ইমাম সাহেবদের সামাজিক অপরাধপ্রবণতা ও নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে গণসচেতনতা সৃষ্টি ও সামাজিক আন্দোলনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com