মিরাজ হয়েছিল নবুওয়াতের ১১ তম বছরের ২৭ রজবে। অবশ্য তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এ বছর নবীজি (সা.)-এর চাচা আবু তালিব ও স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.) অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে ইন্তেকাল করেন। এই বছরকে নবী (সা.)-এর জীবনে ‘আমুল হুজন’ বা দুঃখের বছর বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দুঃখ নিবারণ ও তাঁকে উদ্বুদ্ধকরণার্থে মিরাজ সংঘটিত হয়। তখন নবীজি (সা.)-এর বয়স ৫১ বছর। মিরাজের বিবরণ কোরআন করিমে সুরা নাজমে ও সুরা ইসরায় বিবৃত হয়েছে। বুখারি, মুসলিম, সিহাহ সিত্তাহসহ অন্যান্য কিতাবে এই ইসরা ও মিরাজের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ সূত্রে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘অতঃপর নিকটবর্তী হলো, পরে নির্দেশ করল। তারপর হলো দুই ধনুকের প্রান্তবর্তী বা আরও নিকট। পুনরায় তিনি ওহি করলেন তাঁর বান্দার প্রতি, যা তিনি ওহি করেছেন। ভুল করেনি অন্তর যা দেখেছে। তোমরা কি সন্দেহ করছ তাকে, যা তিনি দেখেছেন সে বিষয়ে। আর অবশ্যই দেখেছেন তিনি তাকে দ্বিতীয় অবতরণস্থলে; সিদরাতুল মুনতাহার কাছে; তার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন ঢেকে গেল সিদরা যা ঢেকেছে; না দৃষ্টিভ্রম হয়েছে আর না তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন; অবশ্যই তিনি দেখেছেন তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ।’ (সুরা নাজম, আয়াত: ৭-১৮)।
মিরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন। পরিভাষায় মিরাজ হলো মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক সশরীরে, সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরাইল (আ.) ও হজরত মিকাইল (আ.)-এর সঙ্গে বুরাক বাহনের মাধ্যমে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা হয়ে প্রথম আসমান থেকে একে একে সপ্তম আসমান এবং সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এবং সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ; মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে দিদার লাভ ও জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে ফিরে আসা। ইসরা হলো মিরাজের একটা অংশ। ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। যেহেতু নবী করিম (সা.)-এর মিরাজ রাত্রিকালে হয়েছিল, তাই এটিকে ইসরা বলা হয়। বিশেষত, বাইতুল্লাহ শরিফ থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফরকে ইসরা বলা হয়ে থাকে। কোরআনুল করিমে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তিনি পবিত্র (আল্লাহ), যিনি তাঁর বান্দাকে “ইসরা” বা রাত্রিভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার আশপাশ আমি বরকতময় করেছি। যাতে আমি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরা, আয়াত: ১)।
প্রিয় নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে মিরাজের সফরে বিভিন্ন নবী-রাসুলের সাক্ষাৎ হয়। প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহইয়া (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদরিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.), সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় হয়। এরপর তিনি বায়তুল মামুরে গেলেন, এটি ফেরেশতাদের কিবলা; যেখানে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা আসেন ও প্রস্থান করেন, যাঁরা দ্বিতীয়বার আসার সুযোগ পান না। (বুখারি: ৩৬৭৪, প্রথম খণ্ড)। অতঃপর সিদরাতুল মুনতাহার কাছে যান। সেখানে চারটি নদী দেখেন।
মিরাজ রজনীতে প্রিয় হাবিবের একান্ত সাক্ষাতে এসব সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়:
‘আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করা যাবে না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে হবে, নিকট আত্মীয়স্বজনের অধিকার দিতে হবে; মিসকিনদের ও পথসন্তানদের অধিকার দিতে হবে; অপচয় করা যাবে না, অপচয়কারী শয়তানের ভাই, কার্পণ্য বা কৃপণতা করা যাবে না, সন্তান হত্যা করা যাবে না, ব্যভিচারের কাছেও যাওয়া যাবে না, মানবহত্যা করা যাবে না, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা যাবে না, প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করতে হবে, মাপে পূর্ণ দিতে হবে, অজ্ঞতার সঙ্গে কোনো কিছু করা যাবে না, পৃথিবীতে গর্বের সঙ্গে চলা যাবে না। এ সবই মন্দ, তোমার রবের কাছে অপছন্দ।’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ২২-৪৪)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail, com