মণ্ডপ ও বাড়ি যখন একাকার

.

পুরান ঢাকার দুর্গোৎসবের সমারোহ মানেই শাঁখারীবাজার। এ সময় শাঁখারীবাজারের রূপ যেন বদলে যায়। বাজারের মূল সড়কের প্রস্থ বড়জোর ১০ ফুট হবে, দুই পাশে পুরোনো দিনের দোতলা, তিনতলা ভবন, তার নিচে শাঁখা, পূজার উপকরণসহ বিভিন্ন মনিহারি দ্রব্যের দোকান। সেই সড়কে ১৫ ফুট পরপর একটি করে পূজার মণ্ডপ— বয়স ৪০, ৫০ বা ৬০ বছর। রাস্তায় বাঁশের খুঁটি পুতে তার ওপর মাচা বসানো হয়েছে, সেই মাচার ওপর মণ্ডপ বানানো হয়েছে। তার নিচ দিয়েই হাঁটতে হয়, সেখানে হাঁটতে গেলে মানুষের গায়ে গায়ে লেগে যায়, তবু মানুষের কমতি নেই, নেই উৎসবের কমতি।
পূজা উপলক্ষে রাস্তার ওপর আরও কিছু ভ্রাম্যমাণ দোকান বসেছে। তারা সবাই পদ্মফুলসহ দুর্গাপূজার বিভিন্ন উপকরণ বিক্রি করছে। মূল পূজার অনুষ্ঠানের সময় সেখানে ঢাকের শব্দ ও উলুধ্বনিতে কান পাতা দায়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ অঞ্জলি দিতে আসেন, অষ্টমী ও নবমীর দিন কত জন অঞ্জলি দেন, সেই হিসাব করার সাধ্য কার! সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পরও কানে ঢাক ও উলুধ্বনির অনুরণন হয়।

পূজার সময় এই ছোট্ট মহল্লার মানুষের যেন দম ফেলার ফুরসত থাকে না। এত এত পূজা, তার জোগাড় তো তাঁদেরই করতে হয়, এ তো আর কম ঝক্কি নয়! যাঁদের সে অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা সেটা বুঝবেন, কিন্তু যাঁদের তা নেই, তাঁদের পক্ষে সেটা বোঝা মুশকিল। নাওয়া-খাওয়া ভুলে এই পূজার পেছনেই সারাদিন লেগে থাকতে হয়।

পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের সবুজ স্বপন সংঘ পূজা কমিটির পূজা মণ্ডপ l ছবি: প্রথম আলো

শাঁখারীবাজারে যেমন বারোয়ারি পূজা আছে, তেমনি বাড়ির পূজাও আছে। শাঁখারী পুষ্পনাথ সেন ২০/২১ বছর ধরে নিজ বাড়ির পূজা করছেন। পঞ্চমীর দিন তাঁর সঙ্গে কথা হলো।  তিনি বললেন, শাঁখারীবাজারে মোট নয়টি পূজা হয়। পাকিস্তান আমলে শাঁখারীবাজারে দুটি বা তিনটি পূজা হতো, স্বাধীনতার পর বেড়েছে। ফুরসত নেই তাঁর। কথার ফাঁকে ফাঁকেই বাড়ির লোকেরা পূজার আয়োজনের বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করছিলেন, তিনিও নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। আরও বললেন, পূজার কটা দিন যে কীভাবে কেটে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। এ সময় বাড়ি আর মন্দির যেন একাকার। খিচুড়ি-লাবড়া-লুচি-পায়েস—পূজার সময় এসবই তাঁদের খাদ্য। এই পূজার বিশেষত্ব হচ্ছে, তাঁরা শারদীয় দুর্গাপূজার প্রতিমা বিসর্জন দেন না, চৈত্র মাসে একই প্রতিমায় বাসন্তী পূজা করার পর মূর্তি বিসর্জন দেন, যদিও সাধারণভাবে দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রতিদিনই তাঁরা দেবীর ভোগ দেন। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দুর্গাপূজা মূলত চৈত্র মাসেই হতো। পরবর্তীকালে রাজা রামচন্দ্র শরৎকালে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন।
পূজার সময় এত মানুষের সমাগমেও শাঁখারীবাজারের বাসিন্দারা বিরক্ত হন না। এমনকি তাঁরা নিজেদের বাড়িতে অনেক দর্শনার্থীদের আপ্যায়ন করেন, প্রয়োজন হলে নারী দর্শনার্থীদের টয়লেট ব্যবহার করতে দেন। এসবই তাঁরা হাসিমুখে মেনে নেন। কারণ, তাঁরা জানেন, শাঁখারীবাজারে না এলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের পূজা সার্থক হয় না।

আসলে শুধু শাঁখারীবাজারই নয়, পুরান ঢাকার মণ্ডপে না ঘুরলে হিন্দুদের পূজা যেন সম্পূর্ণ হয় না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, একসঙ্গে এত পূজার মণ্ডপ ঢাকার আর কোথাও নেই। শুধু সূত্রাপুর থানাতেই ৪০-৪২টি পূজা হয়। আর এখানকার পূজার যে ঐতিহ্য রয়েছে, তার আকর্ষণও মানুষকে টেনে নিয়ে আসে। সেখানে গেলে মানুষ এক ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়।

বাংলাবাজারের পূজার বয়স এবার ৮২ হলো। কয়েক প্রজন্মের আয়োজকেরা এত দিন ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে এই পূজা করে আসছেন। সেখানকার আয়োজকেরা বললেন, অষ্টমীর দিন তাঁরা দুই হাজার মানুষকে খিচুড়ি, লুচি ও পায়েস দিয়ে আপ্যায়ন করেন, এলাকাবাসীর মধ্যে খিচুড়ি বিতরণ করেন। তাঁরা নবমীর রাতে আরতি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন আর দশমীর দিন গরিবদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করেন। ফলে পূজার কটা দিন দম ফেলার ফুরসত থাকে না। এলাকার হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে সবাই তাতে অংশ নেন। তাঁরা বলেন, ঢাকার কিছু স্থানে এখন অনেক জাঁকজমকপূর্ণ পূজা হলেও পুরান ঢাকার আমেজ সেখানে নেই। সে কারণেই পুরান ঢাকার পূজা অনন্য। 

ওদিকে ঋষিকেশ দাস রোডের একরামপুর পূজা কমিটি ৪৪ বছর ধরে পূজা করছে। এর মধ্যে ৪১ বছর ধরে তারা একই স্থানে পূজা করে আসছে। এই পূজা কমিটির অনেক সদস্যই বীর মুক্তিযোদ্ধা আর কমিটির ১০ জন সদস্য মুসলিম ধর্মাবলম্বী।

ঢাকা নগরে পূজার আমেজ পেতে হলে পুরান ঢাকায় যাওয়ার বিকল্প নেই। শাঁখারীবাজার থেকে নর্থ ব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার, ফরাশগঞ্জ, ঋষিকেশ দাস রোড, নারিন্দা, গেন্ডারিয়া—সব স্থানেই রয়েছে ঢাক ও উলুর মিলিত ধ্বনি। সঙ্গে আছে ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার আহ্বান। দশমীতে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজা শেষ হবে। কিন্তু দুর্গাপূজার পর পুরান ঢাকা ঝিমিয়ে পড়বে না, শুরু হয়ে যাবে লক্ষ্মীপূজার আয়োজন, আর তারপর তো কালীপূজা আছেই। সব পূজাই সেখানে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়।