শ্রদ্ধাঞ্জলি

বনভান্তের শততম জন্মদিনে

সাধনানন্দ মহাথেরো
সাধনানন্দ মহাথেরো

পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সারা বিশ্বের বৌদ্ধসমাজে লোকোত্তর সাধক সাধনানন্দ মহাথেরোর শততম জন্মদিন আজ। তিনি ‘বনভান্তে’ নামে সমধিক পরিচিত। ১৯২০ সালের ৮ জানুয়ারি রাঙামাটি শহর থেকে দক্ষিণে মগবান মৌজার মোরঘোনা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। লোকোত্তর সাধক বনভান্তের পবিত্র জন্মভিটাটি এখন আর নেই। কাপ্তাই হ্রদের পানির নিচে তলিয়ে গেছে! পুণ্যার্থী বৌদ্ধ অনুসারীরা বনভান্তের জন্মভিটার স্মৃতিকে জাগ্রত রাখার লক্ষ্যে ওই স্থানে একটি স্তম্ভ তৈরি করেছেন। হ্রদের পানি যখন হ্রাস পায়, তখন ওই স্তম্ভের চূড়া দেখে বনভান্তের জন্মস্থানকে নির্ণয় করা যায়। রাঙামাটি-কাপ্তাই নতুন সড়কের খুব কাছ থেকে এ স্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায়।

স্রোতস্বিনী কর্ণফুলী নদীর তীরে ছায়া-সবুজে ঘেরা শান্ত প্রকৃতির মধ্যেই বনভান্তের শৈশব কেটেছে। বনভান্তের গৃহী নাম ছিল রথীন্দ্র চাকমা। শৈশবে তিনি আশপাশের প্রকৃতির মতোই শান্ত ছিলেন। দুরন্তপনার পরিবর্তে তাঁর মধ্যে সব সময় একটা শান্ত ও ভাবুক প্রকৃতি ছিল। একটু বড় হতেই তিনি বাবাকে হারান। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে অনটনের সংসারে মাকে আর্থিক সহায়তার জন্য একসময় রাঙামাটি শহরে এসে দোকানের সহকারীর কাজ নেন। এরই মধ্যে জনৈক গজেন্দ্র লাল বড়ুয়ার সঙ্গে তাঁর পরিচয়, বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতার সম্পর্ক তৈরি হয়। গজেন্দ্র বড়ুয়াও ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ লোক ও বৌদ্ধধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাসী। মূলত গজেন্দ্র বড়ুয়ার অকুণ্ঠ সমর্থন ও অনুপ্রেরণা পেয়ে রথীন্দ্র তথা বনভান্তের মনে প্রব্রজ্যা গ্রহণের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সহজতর হয়েছিল।

১৯৪৯ সালে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে চট্টগ্রাম বৌদ্ধবিহারে রথীন্দ্র চাকমা প্রথম প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। সেখানে তিন মাস কাটানোর পর নির্বাণ মার্গের (দুঃখ থেকে মুক্তির পথ) উপায় সম্পর্কে কোনো ধারণা না পেয়ে তিনি কাপ্তাইয়ের সন্নিকটে ধনপাতায় ফিরে যান। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর তিনি গভীর অরণ্যে কঠোর সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। তাঁর সাধনাকালীন কাপ্তাই বাঁধ চালু হলে ধনপাতা এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে তাঁকে ওই এলাকা ত্যাগ করতে হয়। পরবর্তীকালে তিনি খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় গিয়ে তাঁর সাধনা চালিয়ে যান। গভীর বনে সাধনা করেন বলে তিনি জনসাধারণের কাছে ‘বন শ্রামণ’ হিসেবে পরিচিতি পান। প্রব্রজ্যা গ্রহণের ১২ বছর পর ১৯৬১ সালের ২৭ জুন জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা তিথিতে তিনি উপসম্পদা (ভিক্ষু) গ্রহণ করেন। ‘বন শ্রামণ’ সাধনাতেই আনন্দ লাভ করেন বলে উপসম্পদা গ্রহণের পর তাঁর নাম রাখা হয় ‘শ্রীমৎ সাধনানন্দ ভিক্ষু’। উপসম্পদা গ্রহণের পর তিনি ‘বন শ্রামণ’ থেকে ‘বনভান্তের’ নামেই বেশি পরিচিতি পান।

ভিক্ষু হওয়ার পর বনভান্তে দীঘিনালায় ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। এরপর তিনি প্রথমে দুরছড়ি ও পরে লংগদুর তিনটিলা বৌদ্ধবিহারে অবস্থান করে বৌদ্ধধর্ম প্রচার এবং ধর্মীয় দেশনা দিয়ে সাধারণ মানুষকে অপকর্ম থেকে দূরে থেকে সৎ পথে সমৃদ্ধ হওয়ার উপদেশ িদয়েছেন। ১৯৭৪ সালে রাজপরিবারের পক্ষে প্রয়াত রাজমাতা বিনীতা রায়, বর্তমান চাকমা রাজার মাতা প্রয়াত আরতি রায় ও সদ্ধর্ম উপাসক-উপাসিকাদের অনুরোধে তিনি রাঙামাটির রাজবনবিহারে অবস্থান করতে সম্মত হন। অবশেষে ১৯৭৭ সালের বৈশাখী পূর্ণিমার প্রাক্কালে তিনটিলা থেকে সশিষ্যে রাঙামাটিতে এসে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করেন।

১৯৭৪ সালে তিনটিলায় থাকাকালীন গৌতম বুদ্ধের সময়ে মহাউপাসিকা বিশাখা কর্তৃক প্রবর্তিত রীতি অনুসরণ করে প্রথমবারের মতো চরকায়
তুলা থেকে সুতা বের করে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কাপড় বুনে চীবর তৈরি করে দান করার প্রথা চালু করেন লোকোত্তর সাধক বনভান্তে; যা আজ অবধি বনবিহারের সব শাখায় প্রথা হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। কঠোর সাধনার মাধ্যমে বনভান্তে নিজের অভীষ্ট লক্ষ্য ও ধ্যানের পূর্ণতা লাভ করেছেন। তেমনি মোহপীড়িত মানুষের মুক্তির পথও তিনি আজীবন দেখিয়ে গেছেন। প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে যে বিহারে বনভান্তে অবস্থান করে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছেন, রাঙামাটির সেই রাজবনবিহার বর্তমানে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থস্থান হিসেবে অধিক পরিচিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিসত্তাদের মধ্যে চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। এ ছাড়া চাক, ম্রো ও খিয়াংদের মধ্যেও অনেকে বৌদ্ধধর্ম অনুসরণ করেন। লোকোত্তর সাধক বনভান্তের আবির্ভাবের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্মের আচারাদি পালন ও প্রচারণা খুবই সীমিত পর্যায়ে ছিল। সেই সময়ে মূলত মারমা ভিক্ষুগণ বৌদ্ধধর্মকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। অন্যদিকে লুরী (তান্ত্রিক)দের মাধ্যমেও সামাজিক ও ধর্মীয় আচারাদি সম্পন্ন করা হতো। পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম ব্যাপকভাবে তেমন একটা বিস্তার লাভ করেনি। লোকোত্তর সাধক বনভান্তে ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্নিহিত জ্ঞান ও পরিধি সম্পর্কে বিশেষ করে চাকমা সমাজে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বৌদ্ধদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ‘কঠিন চীবরদান’ কোন রীতি ও পদ্ধতিতে উদ্‌যাপন করা হয়, সে সম্পর্কে চাকমা সমাজ খুব বেশি অবহিত ছিল না। ১৯৭৪ সালে বনভান্তে সেই প্রাচীন রীতি প্রচলনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের মধে্য অনন্য নজির রচনা করেছেন। বর্তমানে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে বনভান্তের অন্তর্নিহিত সম্যক জ্ঞানের পরিধি ছড়িয়ে পড়েছে।     

বনভান্তে যে সময় প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন, সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের, বিশেষত চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল না বললেই চলে। তাঁরা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অনুকরণ করতেন। বিভিন্ন দেব-দেবী পূজার পাশাপাশি পশু বলি, গাঙপূজা, বৃক্ষপূজা ইত্যাদি রীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। সে সময়ে মূলত লুরী (তান্ত্রিক) গণই ধর্মীয় আচারাদিতে প্রধান ভূমিকা পালন করতেন। কিন্তু কালক্রমে সে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। বনভান্তের আবির্ভাবের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্ম স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বনভান্তে তাঁর জীবদ্দশায় পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাহানি ও নিপীড়নকে কখনোই সমর্থন করেননি। তিনি তাঁর ধর্মীয় দেশনা প্রদানের পাশাপাশি হানাহানি পরিহার করে পারস্পরিক মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর জোর দিতেন। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অন্যায়কে তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে সেসবের প্রতিবাদ করেছেন।

বনভান্তের শততম জন্মদিন উপলক্ষে পয়লা জানুয়ারি থেকে রাঙামাটির রাজবনবিহারে সপ্তাহব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদ্‌যাপিত হচ্ছে। লোকোত্তর সাধক শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাথেরো বনভান্তে ২০১২ সালের ৩০ জানুয়ারি ৯৪ বছর বয়সে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে পরিনির্বাণ লাভ করেন।

ইলিরা দেওয়ান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক