রমজান মাস তাকওয়া অর্জনের মাস। রোজার প্রধান উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের প্রতিও; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৩)। তাকওয়া মানে সতর্কতা, সাবধানতা, আত্মরক্ষা। ষড়্রিপু, তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য হলো মানুষের মানবীয় গুণাবলির শত্রু। যেসব গুণ বা বৈশিষ্ট্য মানুষের জ্ঞানকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের বলা হয় রিপু বা শত্রু। এরা মূলত জ্ঞানের শত্রু। মানুষের মধ্যে এরূপ ছয়টি রিপু বা শত্রু রয়েছে। এগুলো মানব প্রবৃত্তিরই অংশ। এসবের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে সুসভ্য ও উন্নততর করে। এগুলোর যথেচ্ছ ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে পশুরও অধম করে দেয়। অধঃপতনের অতলে নিমজ্জিত করে। রমজানের উদ্দেশ্য হলো ষড়্রিপুর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভের নৈতিক শক্তি অর্জন করা।
মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিদায়াত। আল্লাহ রব্বুল আলামিন সুরা ফাতিহায় মানুষকে হিদায়াতের প্রার্থনা শিখিয়েছেন, ‘আমাদের সঠিক সরল পথ দেখান’ (সুরা-১ ফাতিহা, আয়াত: ৪)। এরই পরিপ্রেক্ষিতেই ৩০ পারা কোরআন নাজিল করা হয়। এই জন্যই সুরা ফাতিহাকে ‘উম্মুল কোরআন’ বা ‘কোরআন জননী’ বলা হয়। হিদায়াতের পূর্বশর্ত হলো তাকওয়া। আল্লাহ তাআলা বললেন, ‘এই কোরআন মুত্তাকিদের জন্য হিদায়াত—সঠিক–সরল পথনির্দেশ’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২)।
ইসলামের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাকওয়া। একজন প্রকৃত মোমিন তাকওয়া দ্বারাই পরিচালিত হন। তাকওয়া মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সত্কাজে অনুপ্রাণিত করে। কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যারা ইমান এনেছ, তারা তাকওয়া অর্জন করো’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৭০)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘যারা ইমান আনল এবং তাকওয়া লাভ করল, তারা আল্লাহর বন্ধু; তাদের কোনো ভয় নেই, দুশ্চিন্তাও নেই’ (সুরা-১০ ইউনুস, আয়াতে: ৬২)। তাকওয়া, তাজকিয়া ও ইহসান ইসলামি শরিয়তের সর্বোচ্চ তিনটি ধাপ। এগুলো শরিয়তের অভ্যন্তরীণ অংশ বা প্রকৃত উদ্দেশ্য। তাকওয়া অর্থ সাবধান হওয়া, সতর্কতা অবলম্বন করা, ভয় করা, বেছে চলা, পরিহার করা ও দূরে থাকা। পরিভাষায় তাকওয়া হলো আল্লাহ ও রাসুল (সা.) কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়াবলি থেকে দূর থাকা। তাকওয়ার মূল কথা হলো আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে সদা ভীত ও সতর্ক থাকা এবং নবীজি (সা.)–এর সুন্নত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর মহব্বত লাভের আশায় সদা সচেষ্ট, উদ্গ্রীব ও উত্কণ্ঠিত থাকা।
তাজকিয়া অর্থ সূচিতা, পবিত্রতা, মানোন্নয়ন, শ্রীবৃদ্ধি ইত্যাদি। পরিভাষায় তাজকিয়া হলো আত্মশুদ্ধি, অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা, আত্মিক উন্নতি, চারিত্রিক উৎকর্ষ। মূলত তাজকিয়া হলো ষড়্রিপু, তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যকে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা এবং মানব চরিত্রের নেতিবাচক গুণাবলি, যথা লালসা, অন্যায় বাসনা, পরনিন্দা, মিথ্যা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মপ্রচার, আত্ম-অহংকার, কার্পণ্য ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়া। মোমিনের প্রকৃত সাফল্য তাজকিয়ার ওপরই নির্ভর করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রকৃত তারাই সফল হলো, যারা আত্মশুদ্ধি অর্জন করল’ (সুরা-৯১ শামছ, আয়াত: ৯)। রমজান হলো তাজকিয়া বা আত্মশুদ্ধির জন্য অনুকূল ও সহায়ক। হজরত ইব্রাহিম (আ.)
দোয়া করেছিলেন এই বলে, ‘হে আমাদের পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনিই পরাক্রমশালী হিকমাতওয়ালা’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৯)।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে আল্লাহ, ইমানদারদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে তাদের মধ্যে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন; তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং তাদেরকে কিতাব শিক্ষা দেন’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৪)। মহান আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘আমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য একজন রাসুল, যিনি তোমাদের নিকট আমার বাণীসমূহ পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন; আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয়, যা কখনো তোমরা জানতে না’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫১)।
হজরত নুমান ইবনে বশীর (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানবদেহে এমন একটি গোশতের টুকরা আছে, যা পরিশুদ্ধ হলে তার পুরো শরীর সঠিকভাবে কাজ করে; আর তা যদি নষ্ট হয়ে যায় তার সমস্ত দেহই বিনষ্ট হয়; জেনে রাখো, তা হলো কলব’ (বুখারি, খণ্ড: ১, হাদিস: ৫০)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমরা এভাবে আল্লাহর ইবাদত করো যেন তোমরা তাকে দেখছ; যদি তোমরা তাঁকে দেখতে না–ও পাও, তবে নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের দেখছেন”’ (বুখারি, খণ্ড: ১, হাদিস: ৪৮)। আল্লাহর অস্তিত্বের উপস্থিতির অনুভূতিই হলো তাকওয়া (তাসাওউফ)।
শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail.com