কোরআন মহান আল্লাহর পাক কালাম বা পবিত্র বাণী। কোরআন শব্দের অর্থ যা পাঠ করা হয়, পাঠযোগ্য ও বারবার পাঠের উপযুক্ত। কোরআন অর্থ যা নিকটে পৌঁছে দেয় বা নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করা যায় বলেই এই নামকরণ।
কোরআনে কারিমে অবতীর্ণ প্রথম সুরার প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দেই পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ‘পড়ো, তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা-৯৬ আলাক, আয়াত: ১)। কোরআন তিলাওয়াত করা মানে আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন করা। ‘দয়াময় আল্লাহ কোরআন শেখানোর নিমিত্তে মানব সৃষ্টি করলেন, তাকে ভাব প্রকাশ শেখালেন।’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ১-৪)।
তিলাওয়াত অর্থ পঠন, অধ্যয়ন ও আবৃত্তিকরণ। কোরআন তিলাওয়াত একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও বহু তাৎপর্যময় আমল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তুমি বিশুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াত করো।’ (সুরা-৭৩ মুজজাম্মিল, আয়াত: ৪)। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে, উম্মে সালামা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরআন তিলাওয়াত করতেন প্রতিটি হরফ স্পষ্ট উচ্চারণ করে এবং প্রতিটি আয়াতে বা বাক্যে থেমে থেমে।’ (তিরমিজি)।
কোরআন তিলাওয়াতে ও শ্রবণে ইমান বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখন তাদের প্রতি কোরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তা তাদের ইমান বাড়িয়ে দেয়।’ (সুরা-৮ আনফাল, আয়াত: ২)। মুসলিমদের যে প্রাথমিক ৭টি বিষয় বিশ্বাস করতে হয়, তার অন্যতম হলো ‘কিতাব’–এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। কিতাব মানে বই বা গ্রন্থ। কোরআন হলো সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ।
কালামে পাকে তিলাওয়াতের বিশেষ তিনটি উপকারিতা রয়েছে। যথা মনের ময়লা দূর হয় ও কলব পরিষ্কার হয়। আল্লাহ তাআলার মোহাব্বত বৃদ্ধি পায় ও নৈকট্য লাভ হয়। প্রতিটি হরফে বা বর্ণে কমপক্ষে ১০টি করে নেকি বা সওয়াব অর্জিত হয়। অর্থ না বুঝে পড়লেও নেকি বা সওয়াব হয়, অর্থ বুঝে পড়লে নেকি বা সওয়াবের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি হয়।
পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণের বিশেষ আদব বা নিয়ম আছে। শ্রবণকারী মনে এই খেয়াল করবেন যে মহান আল্লাহর পবিত্র কালাম পাঠ করা হচ্ছে, তাই অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে শুনতে হবে। (৭: ২০৪)। তিলাওয়াতকারী মনে এই খেয়াল করবেন যে মহান
আল্লাহ বলছেন, ‘পড়ো আমার কালাম, দেখি কত সুন্দর করে পড়তে পারো।’ তাই মহান আল্লাহকে শোনানোর জন্য পড়ছি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কোরআনে কারিম তিলাওয়াত সর্বোত্তম ইবাদত।’ (বুখারি)। ‘যে ব্যক্তি কোরআনের একটি হরফ পাঠ করবে, সে একটি নেকি প্রাপ্ত হবে, আর একটি নেকি দশটি নেকির সমতুল্য।’ (মুসনাদে আহমাদ)। ‘যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করল, তা অনুধাবন করল, এর হালালকে হালাল জানল এবং হারামকে হারাম জ্ঞান করল। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তার স্বজনদের এমন দশজনকে শাফায়াত করে জান্নাতে নেওয়ার সুযোগ দেবেন, যাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।’ (বায়হাকি)।
কোরআন অধ্যয়ন বা গবেষণা ও তিলাওয়াত দুটি স্বতন্ত্র ইবাদত এবং একটি অন্যটির পরিপূরক বা সহায়ক। পূর্ণ কোরআন একবার পড়াকে খতম বলা হয়। খোলাফায়ে রাশেদিন ও আশারায়ে মুবাশ্শারাসহ বিশিষ্ট সাহাবিরা প্রায়ই ৭ দিনে এক খতম কোরআন তিলাওয়াত করতেন, যে কারণে কোরআন শরিফ ৭ মঞ্জিল হয়েছে। এক মাসে বা ৩০ দিনে পড়ার জন্য পারা বা সিপারা ভাগ করা হয়েছে।
কোরআনে কারিম তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন শারীরিক ও মানসিক রোগমুক্তির অন্যতম উপায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কোরআন অন্তরের ব্যাধির আরোগ্য দান করে।’ (সুরা-১০ ইউনুস, আয়াত: ৫৭)। ‘আমি আল–কোরআনে এমন আয়াতসমূহ নাজিল করেছি, যার দ্বারা মুমিনদের রোগমুক্তি ও শান্তি লাভ হয়।’ (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ৮২)। ‘আপনি বলুন, এটা ইমানদারদের জন্য পথনির্দেশ ও রোগমুক্তি প্রদান করে।’ (সুরা-৪১ হা–মিম সাজদাহ, আয়াত: ৪৪)।
যারা কোরআন তিলাওয়াত, অধ্যয়ন ও অনুশীলন থেকে বঞ্চিত থাকবে, তাদের সম্পর্কে হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, ‘যার অন্তরে কোরআন নেই, সে যেন পরিত্যক্ত বাড়ি।’ (তিরমিজি)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম–এর সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail.com