আজান মানে ঘোষণা বা আহ্বান। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় নামাজ আদায়ের জন্য আরবি নির্দিষ্ট শব্দমালা দ্বারা উচ্চ স্বরে ঘোষণা দেওয়াকে আজান বলে। পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের জন্য আজান দেওয়া সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগে আজান দেওয়া যাবে না। কখনো কেউ দিয়ে ফেললে ওয়াক্ত হলে আবার আজান দিতে হবে। নারীদের আজান ও ইকামাত দেওয়া জায়েজ নয়। আজান ও ইকামাত জামাতের নামাজের জন্য সুন্নত, একার জন্যও দেওয়া উত্তম।
যিনি আজান দেন, তাঁকে মুয়াজ্জিন বলে। হাদিস শরিফে আছে, কিয়ামতের দিন মুয়াজ্জিনের গলা সর্বাধিক লম্বা হবে, অর্থাৎ মুয়াজ্জিন হাশরের মাঠে বেশি সম্মানিত হবেন। (বুখারি)।
ফরজ নামাজ শুরুর আগে একাকী বা জামাতে ইকামাত দিতে হয়। ইকামাতের কথাগুলো প্রায় সবই আজানের মতো। ইকামাত দেওয়ার সময় আজানের মতো শাহাদাত আঙুল কানে ঢোকাতে হয় না। দুই হাত ছেড়ে দিয়ে ইকামাত দিতে হয়। আজানের শব্দাবলি ধীরে ধীরে এবং ইকামাতের শব্দাবলি দ্রুত বলতে হয়।
আজান ও ইকামাতের বাক্যগুলো
প্রথমে আল্লাহু আকবার, ‘আল্লাহ মহান’ (চারবার), অতঃপর আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই’ (দুবার), তারপর আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল’ (দুবার), তারপর হাইয়া আলাস সালাহ, ‘নামাজের জন্য আসো’ (দুবার) ও হাইয়া আলাল ফালাহ, ‘কল্যাণের জন্য আসো’ (দুবার) ; পরিশেষে আল্লাহু আকবার, ‘আল্লাহ মহান’ (দুবার) ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই’ (একবার)। ফজরের নামাজের আজানে পঞ্চম বাক্যের (হাইয়া আলাল ফালাহ) পর বলতে হয় আস সালাতু খায়রুম মিনান নাওম, ‘ঘুম অপেক্ষা নামাজ উত্তম’ (দুবার) এবং ইকামাতে এই স্থানে বলতে হয় কদ কমাতিস সালাহ, ‘জামাত প্রস্তুত’ (দুবার)।
আজান ও ইকামাতের জওয়াব
আজান ও ইকামাতের জওয়াব বা প্রত্যুত্তর দেওয়া সুন্নত। এটা মস্ত বড় সওয়াবের কাজ। পুরুষ ও মহিলা সবার ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য। যে মসজিদ সবচেয়ে কাছে অথবা যে মসজিদে তিনি নামাজ আদায় করেন, সেই মসজিদের আজানের জবাব দিতে হবে। বিনা প্রয়োজনে আজানের সময় কথা বলা মাকরুহ। জুমার দ্বিতীয় আজানের জবাব দিতে হয় না। তবে মনে মনে দেওয়া যায়। অজুরত অবস্থায়ও আজানের জবাব দেওয়া যাবে।
জবাবে আজান বা ইকামাতে মুয়াজ্জিনের উচ্চারিত বাক্যটি বলতে হয়; তবে ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ ও ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ বাক্যদ্বয়ের জবাবে প্রতিবার লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ, অর্থাৎ ‘আল্লাহর দয়া ছাড়া মন্দ থেকে বাঁচার ও ভালো কাজ করার কোনো শক্তি নাই’ এবং আস সালাতু খায়রুম মিনান নাওমের জবাবে সদাকতা ওয়া বারারতা ‘তুমি সত্য বলেছ ও ভালো কাজ করেছ’ বলতে হয়; ইকামাতে কদ কমাতিস সালাহর জবাবে আকামাহাল্লাহু ওয়া আদামাহা ‘আল্লাহ এই জামাতকে দায়েম ও কায়েম রাখুন’ বলতে হয়। (বুখারি ও মুসলিম)।
আজানের দোয়া
‘আল্লাহুম্মা রব্বা হাজিহিদ দাওয়াতিত তাম্মাতি ওয়াস সালাতিল কায়িমাতি আতি মুহাম্মাদানিল ওয়াসিলাতা ওয়াল ফাদিলাতা ওয়াদ দারজাতার রফিআতা ওয়াবআসহু মাকামাম মাহমুদানিল্লাজি ওয়াআত্তাহু; ওয়ারজুকনা শাফাআতাহু ইয়াওমাল কিয়ামাতি, ইন্নাকা লা তুখলিফুল মিআদ।’ অর্থ: হে আল্লাহ! এই পরিপূর্ণ আহ্বানের ও স্থায়ী প্রতিষ্ঠিত নামাজের আপনিই প্রভু। হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে ওয়াসিলা এবং সুমহান মর্যাদা দান করুন এবং তাঁকে ওই প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত করুন, যার প্রতিশ্রুতি আপনি তাঁকে দিয়েছেন আর কিয়ামতের দিনে তাঁর সুপারিশ আমাদের নসিব করুন; নিশ্চয় আপনি প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না। আজানের পর দরুদ শরিফ পড়ে এই দোয়া পড়া সুন্নত।
আজান ও ইকামাত সম্পর্কিত কিছু মাসআলাহ
আজান দাঁড়িয়ে দিতে হবে, বসে দেওয়া মাকরুহ। তবে অসুস্থ ব্যক্তি একাকী নামাজ পড়ার জন্য বসে আজান দিলে দোষ নেই। আজান উচ্চ আওয়াজে দিতে হবে। আজানের সময় দুই হাতের শাহাদাত আঙুল দ্বারা উভয় কানের ছিদ্রপথ বন্ধ করা মুস্তাহাব। আজানের শব্দগুলো থেমে থেমে ও দীর্ঘ স্বরে বলা এবং ইকামাতের শব্দগুলো দ্রুত বলা সুন্নত। যদি আজানের বাক্যগুলো থেমে থেমে না বলা হয়, তাহলে পুনরায় আজান দেওয়া মুস্তাহাব। তবে ইকামাতের বাক্যগুলো থেমে থেমে বললে পুনরায় ইকামাত দেওয়া মুস্তাহাব নয়। কাবার দিকে মুখ করে আজান ও ইকামাত দেওয়া সুন্নত। অন্য দিকে মুখ করে দেওয়া মাকরুহ।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail, com