আকিকা শিশুর অধিকার

সন্তান আল্লাহ তাআলার অনন্য উপহার। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার রয়েছে বহু দায়িত্ব ও কর্তব্য। যা ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত ইবাদত হিসেবেই পরিগণিত। অনুরূপ একটি সুন্নত আমল হলো আকিকা। ইসলামের পরিভাষায় সন্তান জন্মগ্রহণের পর আল্লাহর শুকরিয়া ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও শিশুর নিরাপত্তার জন্য পশু উৎসর্গ করাকে আকিকা বলে। আমাদের দেশে অনেকের মাঝে একটি ধারণা আছে যে আকিকার মাধ্যমে শিশুর নামকরণ করা হয়। কিন্তু আসলে তা নয়। শিশুর সুন্দর ও ভালো অর্থবহ নাম রাখা একটি স্বতন্ত্র সুন্নত। আকিকা করা আরেকটি স্বতন্ত্র সুন্নত।

আকিকা সম্পর্কে হাদিস শরিফে রয়েছে: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক শিশুরই আকিকা জরুরি।’ (আবু দাউদ: ২৮৪০; মুসনাদ আহমদ: ২০০৯৫)। হজরত আলী বিন আবি তালেব (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি ছাগল দিয়ে হাসানের আকিকা দিলেন।’ (তিরমিজি: ১৬০২; মুস্তাদরাকে হাকেম: ৭৫৮৯)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইহুদিরা পুত্রসন্তানের আকিকা করত কিন্তু কন্যাসন্তানের আকিকা করত না। তোমরা পুত্রসন্তানের জন্য দুটি ছাগল এবং কন্যাসন্তানের জন্য একটি ছাগল দিয়ে হলেও আকিকা করো।’ (বায়হাকি, সুনানে কুবরা: ১৯৭৬০; মুসনাদ বাযযার: ৮৮৫৭)।

আকিকা করার উত্তম ও সুন্নত দিবস হলো সন্তান জন্মের সপ্তম দিন। সপ্তম দিনে আকিকা করতে না পারলে চৌদ্দতম দিনে বা একুশতম দিনে আকিকা করবে। (তিরমিজি)। যদি তা-ও সম্ভব না হয় তাহলে পরবর্তী সময়ে যেকোনো সময় আকিকা
করা যাবে। তবে সপ্তাহের যেই বারে বা
যেই দিনে সন্তান জন্ম হয়েছে তার পূর্বদিনে করলে তা উত্তম হবে। বিশেষ কোনো কারণে এর ব্যতিক্রম হলেও অসুবিধা নেই। অভাবের কারণে যদি কোনো ব্যক্তি
তার সন্তান শিশু থাকতে আকিকা না করে থাকেন, ওই সন্তান বড় হওয়ার পর যদি তার সামর্থ্য হয়, তখন সে তার নিজের আকিকা করলেও সুন্নত আদায় হবে এবং তার পিতা-মাতাও এর সওয়াব পাবে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) নবুওয়াত পাওয়ার পর নিজের আকিকা নিজে করেছেন।’ (বায়হাকি)।

আকিকা হলো আল্লাহর শুকরিয়া আদায় ও তাঁর নৈকট্য লাভের একটি উত্তম উপায়। আকিকার মাধ্যমে শিশু সব ধরনের বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত থেকে আল্লাহর রহমতে নিষ্কৃতি লাভ করে। এ ছাড়া আকিকার বহু তাৎপর্য ও কল্যাণময় দিক রয়েছে। ‘এতে আছে ধর্মীয়, নাগরিক ও আত্মিক অনেক উপকারী দিক। যথা: ভদ্রোচিত পন্থায় সন্তানের বংশপরিচয় প্রকাশ করা। কারণ, বংশপরিচয় প্রকাশ না করলেই নয়। যাতে অনভিপ্রেত কথার সূত্রপাত না হয়। এ কাজ শিশুটির জন্মের পরমুহূর্তেই তাকে এ কল্পনায় নিয়ে যাবে যে সে তার সন্তানকে মানব কল্যাণের পথে উৎসর্গ করে দিল, যেমন হজরত ইব্রাহিম (আ.) করেছিলেন তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইলকে (আ.)। আকিকার আরেকটি দিক হলো, সন্তান দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া জ্ঞাপন করা। কেননা, সন্তানই অন্যতম সেরা নেয়ামত। আর এ সন্তান হলো পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সম্পদ ও সন্তানসন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত: ৪৬)।

আল্লাহ তাআলা মানুষকে এ প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে সে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে আনন্দিত হয়। তাই মানুষের কাছে তার স্রষ্টা ও দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশই কাম্য। এ জন্যই হজরত হুসাইন (রা.) থেকে সদ্য সন্তানের পিতা হওয়া ব্যক্তিকে অভিবাদন জানিয়ে এমন বলার কথা বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাকে যা দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাতে বরকত দিন। তুমি দানকারীর শুকরিয়া আদায় করো, সে তার বয়স পুরো করুক এবং তোমাকে তার পুণ্য প্রদান করা হোক।’ (মুসনাদ ইবনুল জা ‘দ: ১৪৪৮; ইবন আদি, আল-কামেল: ৭ / ১০১; ইনব আবিদ্দুনইয়া, আল-ইয়াল: ১ / ২০১)। আকিকার ফলে তার পরিজন, প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধব এ সংবাদ জানবে এবং শিশুকে মোবারকবাদ দিতে উপস্থিত হবে। এতে করে সমাজে সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার বন্ধন সুদৃঢ় হবে। সর্বোপরি এতে ইসলামের সামাজিক দায়িত্বচর্চার উপলক্ষ হয়।

যে ধরনের ও যে বয়সের ভেড়া, ছাগল বা দুম্বা কোরবানির ক্ষেত্রে বৈধ, তা দিয়ে আকিকা করতে হবে। গরু, মহিষ বা উট সাতটি ছাগলের সমান ধরে যেভাবে কোরবানি করা যায় অনুরূপ আকিকাও করা যাবে। অনুরূপ একই পশুতে একাধিক আকিকা একত্রে হিস্যা হিসেবে শরিকে করা যাবে এবং কোরবানির সঙ্গেও আকিকার অংশ দেওয়া যাবে।
আকিকার পশু জবেহ করার পর এর ব্যবহার ঠিক কোরবানির পশুর মতোই। ফলে তা তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক ভাগ পরিবার, এক ভাগ সাদাকা ও এক ভাগ হাদিয়ার জন্য। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘মোস্তাহাব হলো আকিকার গোশত নিজেরা খাওয়া, গরিবদের মাঝে দান করা এবং বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে হাদিয়া পাঠানো। যেমন কোরবানির ক্ষেত্রে করা হয়।’ (নাসায়ি: ৪২২৯; শরহু মাআনিল আছার-তহাভি শরিফ: ১০১৫)।

আকিকার পশুর গোশত আকিকাদাতা স্বয়ং, যার জন্য আকিকা সে নিজে, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-অনাত্মীয়, ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবাই আহার করতে পারবেন। কাঁচা গোশত হাদিয়া দিতে পারবেন অথবা রান্না করেও খাওয়াতে পারবেন। (আসান ফিকাহ)।
হাদিয়া বা উপহার দেওয়া ও গ্রহণ করা সুন্নত। কিন্তু বিয়ে-শাদি, সুন্নতে খাতনা ও আকিকার মতো ধর্মীয় ইবাদত ও পর্বগুলোকে এর সঙ্গে শর্তযুক্ত করে পবিত্র ও আনন্দঘন অনুষ্ঠানকে নিরানন্দ ও বিষাদময় করা মকরুহ ও ক্ষেত্রবিশেষে হারাম। (ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম)। উপহার পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইবাদত অনুষ্ঠান করা অত্যন্ত গর্হিত ও গুনাহের কাজ। (ইমদাদুল আহকাম)।

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) বলেন, আকিকার পশুর চামড়া এবং যা বিক্রয় না করে পারা যায় না, সে অংশগুলো বিক্রি
করা হবে, তারপর তার মূল্য সদকা করা হবে। আকিকার বর্জ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘চামড়া ও বিক্রয়যোগ্য বর্জ্য বিক্রি করা হবে এবং তা সদকা করা হবে।’ (তুহফাতুল মাওদুদ: ৭০; কাশশাফুল কিনা: ৩ / ৩১)। অথবা সদকার হকদার এমন কাউকে দান করে দেওয়া যাবে। (আহসানুল ফাতাওয়া)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com