নৌকার ব্যাজ ঝুলিয়ে ‘ভোট চাওয়া’ হয়েছিল জায়েদা খাতুনের পক্ষে, গাজীপুরে আওয়ামী লীগের কর্মীদের কারও কারও এই ‘ছদ্মবেশ’ বিপাকে ফেলেছিল দলের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে। বরিশালেও একই দুশ্চিন্তায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের বাকি আর পাঁচ দিন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ জোর প্রচার চালাচ্ছেন। কিন্তু দলের ভেতরে যে পুরোনো বিভেদ ছিল, তা দূর হয়নি।
খায়েরের পক্ষের নেতা-কর্মীদের আশঙ্কা, বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীরা দলের চাপে নৌকার পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচারণা চালালেও ভেতরে ভেতরে খায়ের আবদুল্লাহর বিপক্ষে কাজ করতে পারেন। সেটা হলে তা বেশি ক্ষতির কারণ হবে।
১২ জুন বরিশাল সিটিতে ভোট গ্রহণ হবে। সেখানে খায়ের আবদুল্লাহকেই প্রধান প্রার্থী হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কে হবেন, সেটা নিয়ে এখন আলোচনা বেশি। তবে ভোটার উপস্থিতি বেশি হলে, বিএনপির ভোটাররা কেন্দ্রে গেলে এবং আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের একটি অংশ দলের বিপক্ষে কাজ করলে ভোটের অঙ্ক পাল্টে যেতে পারে বলেও মনে করেন অনেকে।
স্থানীয় রাজনীতি বিশ্লেষকেরা মনে করেন, খায়ের আবদুল্লাহর বড় সুবিধা হলো তাঁর বিরুদ্ধে এমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, যাঁর বড় সমর্থন ও সাংগঠনিক শক্তি আছে।
বরিশালে তাই এখনো সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়ে গেছে। যেটা নিয়ে গত ৩০ মে বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, ‘গাজীপুরের নির্বাচনে আমরা অনেক বেইমান-বিশ্বাসঘাতককে চিনতে পেরেছি। ১২ জুন বরিশাল সিটি নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে বিশ্বাসঘাতকদের কোনো জায়গা হবে না। কারণ, ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘরে শত্রু রেখে লড়াই করা যায় না।’
বাহাউদ্দিন নাছিমের বক্তব্যের পর কীর্তনখোলার পানি অনেক গড়িয়েছে। সাদিকের অনুসারীরা প্রকাশ্যে খায়েরের পক্ষে প্রচারে নেমেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও খায়ের আবদুল্লাহ প্রকাশ্যে আলিঙ্গন করে বিভেদ দূরের বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু এসব কিছুর মধ্যে আন্তরিকতা কতটুকু, সেটাই বড় চিন্তা খায়ের-অনুসারীদের।
মনোনয়ন ঘিরে দলের মধ্যে ক্ষোভ ও মান-অভিমান ছিল, তা ৩ জুন কেন্দ্রীয় নেতাদের ডাকা বিশেষ সভার মধ্য দিয়ে অনেকটাই নিরসন হয়েছে। এখন দলের পূর্ণশক্তি নৌকাকে বিজয়ী করার জন্য মাঠে নেমেছে।গোলাম আব্বাস চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে দলটির জাতীয় কমিটির সদস্য
খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, দলের মধ্যে মনোনয়ন নিয়ে সৃষ্টি হওয়া অবিশ্বাস নিরসনে কেন্দ্রীয় নেতারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মাঠে এর কিছু প্রতিফলন দেখা গেলেও সেটা কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে হচ্ছে, তা নির্ণয় করা কঠিন। তিনি বলেন, ‘বরিশালে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিশ্বাসঘাতকতা বারবার দেখেছি। সেসব ইতিহাস আমাদের বিশ্বাসের জায়গাটা নড়বড় করে দিয়েছে। তাই আমরা এই মুহূর্তে বিশ্বাসও করতে চাই না, আবার অবিশ্বাসও করতে চাই না।’
২০১৩ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেন হিরন। মেয়র হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া হিরণকে ১৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেন বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আহসান হাবিব কামাল। সন্দেহ করা হয়, তখন হিরনের বিপক্ষে কাজ করেছিল আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ।
দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের অসহযোগিতায় গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যান আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান। সেখানে মেয়র পদে জয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ গোপনে জাহাঙ্গীর আলমের মায়ের পক্ষে কাজ করেন। ফলে প্রচারে পিছিয়ে থাকলেও জায়েদা খাতুন নৌকার প্রার্থীকে ১৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেন।
বরিশালে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ ও দলীয় প্রার্থী তাঁর চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহর মধ্যে বিভেদ শুরু থেকেই। কেন্দ্রীয়ভাবে আওয়ামী লীগ বিভেদ নিরসনে নানাভাবে চেষ্টা করেছে। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে প্রধান করে ৯ সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখনো খায়েরের সঙ্গে জোর প্রচারণায় শুধু সাদিকবিরোধী আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীরা। তাঁদের একাংশ প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের অনুসারী, আরেকাংশ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থক। সিটি করপোরেশনের বর্তমান ১০ জন কাউন্সিলরও খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে কাজ করছেন। সাদিকের অনুসারীরা দলের প্রার্থীর পক্ষে ততটা সক্রিয় নন।
অবশ্য বিভেদ এখন আর নেই বলে মনে করেন বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে দলটির জাতীয় কমিটির সদস্য গোলাম আব্বাস চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মনোনয়ন ঘিরে দলের মধ্যে ক্ষোভ ও মান-অভিমান ছিল, তা ৩ জুন কেন্দ্রীয় নেতাদের ডাকা বিশেষ সভার মধ্য দিয়ে অনেকটাই নিরসন হয়েছে। এখন দলের পূর্ণশক্তি নৌকাকে বিজয়ী করার জন্য মাঠে নেমেছে।
কিন্তু সাদিক দলের মনোনয়ন ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত বরিশালে যাননি। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ যেতে পারছেন না নির্বাচনী আচরণবিধির কারণে। খায়ের আবদুল্লাহর প্রচারে মেয়র হিসেবে সাদিক আবদুল্লাহর কার্যক্রমের সমালোচনা আসছে।
স্থানীয় রাজনীতি বিশ্লেষকেরা মনে করেন, খায়ের আবদুল্লাহর বড় সুবিধা হলো তাঁর বিরুদ্ধে এমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, যাঁর বড় সমর্থন ও সাংগঠনিক শক্তি আছে। প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান ওরফে রূপণ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তিনি ছাত্রদলের সাবেক নেতা। তবে বিএনপির নেতা–কর্মীরা পূর্ণশক্তিতে তাঁর পক্ষে নামেননি। কারণ, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি ফয়জুল করিম ও জাতীয় পার্টির (জাপা) ইকবাল হোসেন প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাঁরা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। তবে অতীতে দল দুটি বরিশাল সিটি নির্বাচনে বড় কোনো সমর্থকভিত্তি দেখাতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের বিভেদ অন্য কারও জন্য সুবিধাজনক হবে, নাকি অন্যদের দুর্বলতায় খায়ের উতরে যাবেন, সেই আলোচনা বরিশালজুড়ে।