আজ বেলা তিনটায় রাজধানীতে হোটেল ওয়েস্টিনের দোতলার হলরুমে পৌঁছে দেখি, লোকে কানায় কানায় পূর্ণ। সাংবাদিকদের সামনে বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা উপস্থাপনের ঘোষণা থাকলেও দলীয় নেতা ও জোটসঙ্গীদের আধিক্য ছিল। থাকারই কথা। খোলা রাস্তায় সমাবেশ করতে যখন নানা ঝক্কিঝামেলা, তখন হোটেলকক্ষে একত্র হওয়াটাই নিরাপদ মনে করেছেন তাঁরা।
আয়োজনটি ছিল বেশ পরিচ্ছন্ন। বক্তৃতার বাড়াবাড়ি ছিল না। দলের একজন যুগ্ম মহাসচিবের সূচনা বক্তব্যের পর স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের বিস্তারিত রূপরেখা ঘোষণা করেন। বলা হয়েছে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা ও দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০-এর আলোকে এটি তৈরি করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এ রূপরেখায় খুব বেশি নতুনত্ব নেই। তবে ভিশন ২০৩০-এর চেয়ে ‘রাষ্ট্র মেরামত’ কথাটি অনেক বেশি আকর্ষণীয় হবে জনগণের কাছে। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো বিরোধী দলে থাকতে রাজনীতিকেরা গণতন্ত্র, সুশাসন ও সহিষ্ণুতার চর্চা নিয়ে অনেক কথা বলেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরা বেমালুম ভুলে যান এবং পূর্বসূরির তৈরি করা জুতায় পা রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এটি বিএনপির জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি আওয়ামী লীগের জন্যও।
বিএনপি যদি এ রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা ক্ষমতায় থেকে দিত, সেটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হতো। এখন সমালোচকেরা একে ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল হিসেবেও দেখতে চাইবেন। বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখার মূল কথা হলো রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে পরপর কেউ দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে বিধানটি এখনো বহাল আছে। এ কারণে আওয়ামী লীগকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে একজন নতুন রাষ্ট্রপতি খুঁজতে হচ্ছে।
বিএনপির রূপরেখায় জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। কাদের নিয়ে এই জাতীয় ঐকমত্য বা জাতীয় সরকার হবে? রূপরেখামতে, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যেসব রাজনৈতিক দল আন্দোলন করছে, তাদের নিয়ে।
আমরা যদি ধরেও নিই যে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বিরোধী দল সফল হলো এবং ১৯৯৬ সালে যেমন বিএনপিকে আওয়ামী লীগ নির্দলীয় সরকার গঠনে বাধ্য করেছিল, এবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট বা সহযোগীরাও আওয়ামী লীগকে দিয়ে সে রকম কিছু করাতে বাধ্য করল (যদিও আজ পত্রিকায় দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আওয়ামী লীগকে উৎখাত করা অত সহজ নয়) এবং নির্বাচনে বিএনপি ও তার সহযোগীরা জয়ী হয়ে সরকার গঠন করল। তারপরও সেটি জাতীয় সরকার বা ঐকমত্যের সরকার হবে না। ঐকমত্যের সরকার করতে হলে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে ন্যূনতম সমঝোতা থাকতে হবে, যার সম্ভাবনা আপাতত নেই। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় এসে বিএনপির দুই সংসদ সদস্যকে মন্ত্রী করে ঐকমত্যের সরকার করেছিল, যা পরে হাস্যকর বলে গণ্য হয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের ভিশন ২০৩০-এ যে সংসদের উচ্চকক্ষ চালুর কথা বলেছিলেন, এখানেও সেটি বলা হয়েছে। অর্থাৎ এটিও নতুন ধারণা নয়। এ ছাড়া রূপরেখায় অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন, নির্বাচন কমিশন আইন সংশোধন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, দেশীয় জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান, ন্যায়পাল নিয়োগ, ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য কমানো, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবার বাজেট বৃদ্ধি, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের তালিকা তৈরি করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বলেই মনে হয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো মিলিয়ে দেখলে খুব পার্থক্য পাওয়া যাবে না।
তবে এই রাষ্ট্র মেরামতের প্রস্তাবে বিএনপি যে ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ স্লোগানটি সংযুক্ত করেছে এবং দেশের ভূখণ্ডে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে আশ্রয়প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলে যে অঙ্গীকার করেছে, সেটি তাৎপর্যপূর্ণ। তারা আগের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে অনেকখানি সরে এসেছে। একইভাবে তারা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দলীয়ভাবে না করার কথাও বলেছেন, যা দেশের গরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যাশা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের প্রস্তাবও আমরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি।
রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা উপস্থাপনের আয়োজনে বিএনপির কয়েক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা হলো। তাঁদের বেশ আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হলো। যদিও তাঁরা জানেন না, কীভাবে এটি বাস্তবায়িত হবে? নির্বাচনের আগে না পরে? আবার দলের মধ্যম পর্যায়ের কয়েক নেতার মুখে হতাশা ও ক্ষোভের কথাও শোনা গেল। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেপ্তার হন কয়েক দিন আগে। বাইরে থাকলে তাঁরই রূপরেখা উপস্থাপন করার কথা। কিন্তু কারও কণ্ঠে তাঁর নামটি উচ্চারিত না হওয়া অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। একজন নারীনেত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, যেখানে দেশের ৫০ শতাংশ নারী, সেখানে আমাদের বিষয়টি এসেছে ২৪ নম্বরে। এটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। আরেক নেতা দলীয় সংসদ সদস্যদের এ মুহূর্তে পদত্যাগের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
আশা করি, বিএনপির নেতারা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করবেন।