শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম নেননি রওশন এরশাদ। ফলে ৩২ বছর পর রওশনকে ছাড়াই নির্বাচনে নামল জাতীয় পার্টি (জাপা)। একইভাবে রওশনের ছেলে সাদ এরশাদও এবার নির্বাচনে নেই।
জাপার জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তাঁকে নানাভাবে বোঝানো হয়েছে। মহাসচিব একাধিকবার ফোন করেছেন, এমনকি ফরম নিয়ে তাঁর বাসায়ও যেতে চেয়েছেন। তিনি মানা করে বলেছেন, লোক পাঠাবেন। এরপর আমরা তাঁর জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলাম। শুনেছি, তাঁকে কেউ ফরম নিতে দেয়নি।’
এই নির্বাচনে রওশন এরশাদের অনুসারী অনেক নেতাকে জাপার মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে দলের সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান (রাঙ্গা), জিয়াউল হক মৃধা, গোলাম মসীহ, কাজী মামুনূর রশীদ ও ইকবাল হোসেন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া নির্বাচনী আসন নিয়ে একমত হতে না পারায় রওশনের ছেলে সাদ এরশাদও মনোনয়ন পাননি। এ কারণে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকছেন রওশন এরশাদ। তাঁর নির্বাচনী এলাকা ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনে জাপার উপজেলা সভাপতি আবু মো. মুছা সরকারকে প্রার্থী করা হয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিবুর রহমান।
এদিকে জাপার মনোনয়ন না পেয়ে মসিউর রহমান রংপুর-১ আসনে ও জিয়াউল হক মৃধা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মসিউর রহমানের আসনে জাপার প্রার্থী মকবুল শাহরিয়ার আসিফ। তিনি এরশাদের ভাতিজা ও সাবেক সংসদ সদস্য। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম।
এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার আসন সমঝোতা হয়নি। ফলে দলটির কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সব আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছে। জি এম কাদের গতকাল বৃহস্পতিবার দুটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। একটি ঢাকা-১৭, অন্যটি রংপুর-৩ আসন। ঢাকার আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, আর রংপুরে তুষার কান্তি মণ্ডল। এ ছাড়া জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে নাসিরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদের চট্টগ্রাম-৫ আসনে আবদুস সালাম, কাজী ফিরোজ রশীদের ঢাকা-৬ আসনে সাঈদ খোকন, সৈয়দ আবু হোসেনের ঢাকা-৪ আসনে সানজিদা খানম, সালমা ইসলামের ঢাকা-১ আসনে সালমান এফ রহমানকে প্রার্থী করেছে আওয়ামী লীগ। এতে জাপার নেতাদের অনেকে উৎকণ্ঠায় আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার উচ্চপর্যায়ের একজন নেতা গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যে এবার কাকে দিয়ে কী করতে চাইছে, কিছুই বুঝতে পারছি না।’
জাপার দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, রওশন এরশাদ এবার ছেলে সাদের আসন নিয়ে আপত্তির জেরে নির্বাচনে না গেলেও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সমঝোতার বিষয়ে চেষ্টা ছিল। তাঁকে সরকারের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্তও মনে করা হয়। রওশন এরশাদ ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছয়বারের সংসদ সদস্য। এর মধ্যে ২০০৮ সালে তিনি ভোটে হেরে যাওয়ার পর উপনির্বাচনে এরশাদের ছেড়ে দেওয়া রংপুর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ আমৃত্যু এই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০১৮ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে সাদ এরশাদ সংসদ সদস্য হন। এবারও সাদ প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে রাজি হননি জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এবার তিনি নিজেই এই আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন।
অবশ্য ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচন এরশাদ বর্জনের ঘোষণা দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও তখন রওশন এরশাদ দলের একটি অংশকে নিয়ে নির্বাচন করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি জাপার মনোনয়নে নেতৃত্ব দেন। নির্বাচনের পর দলের চেয়ারম্যান এরশাদকে বাইরে রেখে তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হন। এবার তার ব্যতিক্রম ঘটল।
জাপার নেতারা বলছেন, রওশন এরশাদবিহীন এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আপাতত দলে জি এম কাদেরের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করল। দীর্ঘদিন ধরে দলের নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন বিষয়ে জি এম কাদেরের সঙ্গে রওশনপন্থীদের দ্বন্দ্ব চলছিল, যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়, যা এখনো অমীমাংসিত।
দলটির কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন ঘটনাটি ঘটবে, কখনো ভাবিনি। রাজনীতিতে সবকিছু হতে পারে, বুঝলাম অবশেষে।’