আন্দোলনে সক্রিয় বিএনপির তৃণমূল, কিন্তু আছে সংশয়

রাজধানীর গোলাপবাগে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

চলমান আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, এর ফলই–বা কী হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে বিএনপির তৃণমূলে। দলটির মাঠপর্যায়ের নেতা–কর্মীদের অনেকে বলছেন, মাঠের জনসমর্থন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিপক্ষে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা হলে বিএনপিই জয়ী হতে পারে। কিন্তু তাদের ভয় ‘প্রশাসন’ ও ‘রাষ্ট্রযন্ত্র’ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে কি না, এ নিয়ে বিএনপির তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের কারও কারও মধ্যে এখনো কিছুটা সন্দেহ রয়েছে।

রাজধানী ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরের বিএনপির মাঠপর্যায়ের একাধিক নেতা এবং কর্মী ও সমর্থকের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এ মনোভাব পাওয়া গেছে।

দলের মাঠপর্যায়ের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী মনে করেন, বিএনপি যে প্রক্রিয়ায় সপ্তাহান্তে কর্মসূচি দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে সক্রিয় নেতা-কর্মীরা হাঁপিয়ে উঠছেন। ফলে আন্দোলন কর্মসূচি এভাবে আর কত দিন চলবে এবং শেষ পর্যন্ত তা কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা নিয়ে ধোঁয়াশায় আছেন অনেকে।

বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অনেকে মনে করেন, তাঁদের কিছু কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হচ্ছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে অর্থে সাধারণ মানুষকে তাঁদের কর্মসূচিগুলোতে শামিল করা যায়নি।

ছয় মাসের বেশি সময় ধরে নানা রকম কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে বিএনপি। এই সময়ে হরতাল বা অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি ছাড়া শান্তিপূর্ণ পন্থার হেন কোনো কর্মসূচি নেই, যা তারা পালন করেনি। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, প্রতীকী অবস্থান, গণসমাবেশ, গণমিছিল ও গণ–অবস্থানের পর এখন দলটি ব্যস্ত গ্রাম পর্যায়ে ‘পদযাত্রা’ কর্মসূচি নিয়ে।

গত ৩১ জানুয়ারি রাজধানীর গাবতলীতে এক পদযাত্রা কর্মসূচিতে কথা হয় বিএনপির সক্রিয় কর্মী জাকির হোসেনের সঙ্গে। তিনি মিরপুরের রূপনগর এলাকার বাসিন্দা। জাকির হোসেন সেদিন অপেক্ষা করছিলেন গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত যে পদযাত্রা কর্মসূচি হয়, তাতে অংশ নেওয়ার জন্য।

এ আন্দোলনের শেষ কী দেখেন—এমন প্রশ্নে জাকির হোসেন বলেন, ‘এটা বলা কঠিন। তবে এটুকু বলতে পারি, এ সরকারকে দমাতে হলে গণ–আন্দোলন লাগবে, বহির্বিশ্বের চাপও লাগবে।’

আন্দোলন নিয়ে কেন সংশয়

বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অনেকে মনে করেন, তাঁদের কিছু কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হচ্ছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে অর্থে সাধারণ মানুষকে তাঁদের কর্মসূচিগুলোতে শামিল করা যায়নি। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তাঁরা বলছেন, সরকার সে সুযোগ দিচ্ছে না। মামলা দিয়ে, হামলা করে বিএনপিকে জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।

বিএনপির প্রায় সব নেতা-কর্মীই মনে করছেন, এবারের আন্দোলন দল হিসেবে বিএনপির জন্য এক রকম অস্তিত্বের প্রশ্ন। একই সঙ্গে মাঠের নেতা-কর্মীদের জন্য তা জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তেজগাঁও থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনগণকে সংগঠিত করেন মাঠের নেতারা। আমি এলাকাতেই যেতে না পারি, সংগঠিত করব ক্যামনে।’

বিএনপির নেতা-কর্মীরা জানান, প্রতিটি ওয়ার্ডে, থানায় অসংখ্য নেতা-কর্মী আছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে ৫০-৬০টি করে মামলা আছে। ভয়ে এলাকায় যেতে পারেন না।

এলাকায় গেলে যে কী হয়, সে সম্পর্কে নিজের একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) চট্টগ্রাম উত্তর জেলার কোষাধ্যক্ষ খায়রুল ইসলাম নিজামী। তিনি সীতাকুণ্ড উপজেলার ২ নম্বর বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের পশ্চিম লালানগর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সীতাকুণ্ড পৌর বিএনপির আহ্বায়ক ইউসুফ নিজামীসহ তাঁরা কয়েকজন আবদুল হাকিম মিয়াজির বাড়িতে আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ ওই বাড়িতে হামলা হয়। এতে দুজন আহত হন। 

খায়রুল ইসলাম নিজামী অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ওই হামলা চালিয়েছিলেন।

এ অভিযোগের সমর্থনে তিনি বলেন, ঘটনার সময়ই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের ফোন করে জানানো হয়। তাঁরা বলেছেন, ভুল তথ্যের কারণে এটি হয়েছে। তাঁরা শুনেছেন, ওই বাড়িতে জামায়াত-শিবির নাকি গোপন বৈঠক করছে।

দলটির নেতাদের একটি পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, চলমান আন্দোলনে বিএনপির সব পর্যায়ের কমিটির নেতাদের অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কর্মীরাও ভালোভাবে সক্রিয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখনো সেভাবে নামেননি। নেতারা মনে করেন, এর বড় কারণ হচ্ছে ভয়। দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অত্যাচার-নির্যাতন করে সরকার সারা দেশে একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সংকট, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাটের কারণে মানুষ ক্ষমতাসীনদের ওপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। কিন্তু তাঁরা ভীত। এই ভয় কাটাতে না পারলে সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামানো বা গণ–অভ্যুত্থান পরিস্থিতি তৈরি করা কঠিন হবে।

এ প্রসঙ্গে মিরপুরের জাকির হোসেন সেদিন অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করেই বলছিলেন, চালের কেজি ২০০ টাকা হলেও পাবলিক চাল কিনবে, কিন্তু রাস্তায় নামবে না। কারণ, তারা সরকারকে ভয় পায়।

ভিন্নমতও আছে তৃণমূলে

দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনেকের ভিন্নমতও আছে। তাঁরা বলছেন, ভালো কিছু অর্জন করতে হলে ঝুঁকি নিতে হবে, ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বিএনপির শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৩৬ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। ঝুঁকি নিয়েই তাঁরা মাঠে আন্দোলন-কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।

১ ফেব্রুয়ারি গাবতলীর পদযাত্রা কর্মসূচিতে কথা হয় নিপা নামের মহিলা দলের এক নেত্রীর সঙ্গে। জানালেন, তিনি শাহ আলী থানা মহিলা দলে আছেন।

নিপা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন, ‘পুলিশ পক্ষ না নিয়ে আন্দোলন করতে দিলে, নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন হলে আমরাই জয়ী হব।’

তবে দলের কেন্দ্র থেকে মাঠের—সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা মনে করেন, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে কোনোভাবেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। আন্দোলনের চাপে পড়ে সরকার যদি বিএনপিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ দু–চারটি মন্ত্রণালয় ছেড়েও দেয়, তবু নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। এবার সরকারের কোনো কথায় আস্থা রাখা যাবে না।

ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার রাধানগর ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক রবিউল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) আসন। সুষ্ঠু ভোট হলে ৭০ শতাংশের ওপরে পাবে ধানের শীষ। অথচ ছাগলনাইয়ায় এখন বিএনপির পোস্টার লাগানোর লোকের অভাব। কারণ সন্ত্রাস। তাই প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন হলে বিএনপি কেন্দ্রেও যেতে পারবে না।’

বিএনপির প্রায় সব নেতা-কর্মীই মনে করছেন, এবারের আন্দোলন দল হিসেবে বিএনপির জন্য এক রকম অস্তিত্বের প্রশ্ন। একই সঙ্গে মাঠের নেতা-কর্মীদের জন্য তা জীবন–মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এ আন্দোলনে ব্যর্থ হলে অসংখ্য নেতা-কর্মী হতাশায় নিমজ্জিত হবেন। তাঁদের কেউ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন, কেউবা দল ছেড়ে যাবেন। আবার এমনও অনেকে আছেন, তাঁরা বিশ্বাসই করতে চান না, আন্দোলনে হারবেন। এমন একজন শাহ আলী থানা বিএনপির নেতা আলমগীর। ৪ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে ভাসানী ভবনের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বক্তব্য শুনছিলেন। 

এভাবে আর কত দিন আন্দোলন করবেন, এমন প্রশ্নে আলমগীরের তৎক্ষণাৎ জবাব, ‘এখন তো গা গরম রাখছে সপ্তাহ পরপর কর্মসূচি দিয়ে। দেখেন না, রোজার পর কী হয়।’

তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের এমন নানা ভাবনার মধ্যেই বিএনপি জনসম্পৃক্ত বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে। এর মধ্যে দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচিকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গ্রামে গ্রামে মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।

বিএনপির চলমান আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে গত রোববার কথা হয় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি গণতান্ত্রিক দলের জন্য এ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াই একটি বিজয়। নানা প্রতিঘাতের মধ্যে আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি সফলভাবে করছি। এটা যদি চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর গণতান্ত্রিক বিশ্বের চাপ বাড়বে। এ বার্তা কিন্তু ইতিমধ্যে তাদের (সরকারের) কাছে গেছে।’