পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে কিছুটা পরীক্ষায় ফেলতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কারণ, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়—এই অবস্থান থেকে বিএনপির সরে আসা কঠিন। এ পটভূমিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে মনে করেন, বিএনপি সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী না দিলে দলটিতে অসন্তোষ হতে পারে। আবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয়ের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ কমে যাবে। ফলে সুষ্ঠু ভোট হলে এটা নিয়ে সমালোচনার সুযোগও পাবে না বিএনপি।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের বছরে পাঁচ সিটি করপোরেশনেই বিএনপি জয়ী হয়েছিল। তখন দলটি নিজেদের জনপ্রিয় দল হিসেবে প্রচার করেছিল। এবার আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির সামনে এই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, এখন বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নিলে আওয়ামী লীগের একধরনের রাজনৈতিক বিজয় হবে। আওয়ামী লীগ বলতে পারবে, বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। তারা নির্বাচনের পথে এসেছে। আর বর্জন করলে নিজের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে পারবে না বিএনপি। উল্টো আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা অনায়াসে জয় পেয়ে যাবেন।
ইসি ঘোষিত তফসিল অনুসারে, আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণ হবে। খুলনা ও বরিশালে ভোট হবে আগামী ১২ জুন। আর ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে ফরম বিক্রি ও জমা নেওয়া শেষ করেছে। পাঁচ সিটিতে ৪১ জন মেয়র পদে আগ্রহ প্রকাশ করে ফরম জমা দিয়েছেন। আগামী শনিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহীতে বর্তমান মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন—এটি অনেকটা নিশ্চিত। খুলনাতেও বর্তমান মেয়র তালুকদার আবদুল খালেককেই বেছে নেওয়া হতে পারে। বরিশালে শেষ পর্যন্ত বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকেই বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে গাজীপুর ও সিলেটে। গাজীপুরে সর্বাধিক ১৭ জন ও সিলেট ১০ জন মেয়র পদের জন্য দলীয় ফরম সংগ্রহ করেছেন।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের দুজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে বেশ কিছু জরিপ প্রতিবেদন সদস্যদের দেওয়া হয়। এতে জনপ্রিয়তায় কারা এগিয়ে, সেই চিত্র থাকে। এ ছাড়া দলের স্থানীয় নেতাদের সমর্থন কার বেশি, এটাও আলোচনায় আসে। ফলে কে কোন সিটিতে দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন, এটা আগে থেকে বলা মুশকিল। দলীয় প্রধান জরিপের ওপর ভিত্তি করে একধরনের মত দেন। অন্য সদস্যরাও নিজেদের মত দেওয়ার পর প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়।
মনোনয়ন বোর্ডের আরেক সদস্য বলেন, নির্বাচন এখনো দেরি আছে। ফলে শনিবারের বৈঠকে সব সিটির প্রার্থী ঘোষণা না–ও দেওয়া হতে পারে। মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা হয়তো দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। পরে ঘোষণা করা হতে পারে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক দল, সব সময়ই নির্বাচনে বিশ্বাস করে। ফলে যেকোনো নির্বাচনে গুরুত্ব দিয়ে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। এবারও পাঁচ সিটিতে যোগ্য প্রার্থী দিয়ে তাদের জয়ী করে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে ক্ষমতাসীন দল। তিনি বলেন, পাঁচ সিটির ভোট অত্যন্ত সুষ্ঠু হবে। বিএনপি মাঠে আন্দোলন আন্দোলন যে খেলা খেলছে, সেটা কোনো কাজে আসবে না। তাদের নির্বাচনে এসে জনপ্রিয়তা প্রমাণ করা উচিত।
বিএনপির জন্য পরীক্ষা
আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি করপোরেশনের ভোট যাতে অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়, সেদিকে নজর আছে আওয়ামী লীগের। কারণ, এই ভোটে আওয়ামী লীগের হারানোর তেমন কিছু নেই; বরং বিএনপির জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেটের উদাহরণ টানেন। ওই নেতা বলেন, সিলেটে আওয়ামী লীগের ১০ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে সম্ভাবনা বেশি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর। অথচ বাকি নয়জন আবার তাঁর বিরোধী। অর্থাৎ এখানে আওয়ামী লীগের দুর্বলতা আছে। বর্তমান মেয়র বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী। তাঁকে বিএনপি মনোনয়ন দিলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয় কঠিন হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে আরিফুল হককে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিলে অন্য সিটিতে বিএনপির নেতারা ক্ষুব্ধ হবেন। আবার আরিফুলকে প্রার্থী হতে না দিলে একজন শক্তিশালী প্রার্থীকে বসিয়ে দেওয়ার কারণে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে সিলেটের বিএনপিতে।
গাজীপুরেও আওয়ামী লীগের ভেতরে দ্বন্দ্ব আছে। সাময়িক বরখাস্ত বর্তমান মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের দলীয় কোনো পদ নেই। তবে সিটি করপোরেশনের ৭৬ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৬১ জন তাঁর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অন্যদিকে আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আজমত উল্লা খান গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। দলের বিভিন্ন স্তরে তাঁর লোকজন রয়েছে। ফলে এই দুজনের যেকোনো একজন দলীয় মনোনয়ন পেলে দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব বা কোন্দল বেড়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি প্রার্থী দিলে আওয়ামী লীগের জন্য বেকায়দা হয়ে যেত। ভোট বর্জনের পুরোনো সিদ্ধান্তের কারণে এখানেও বিএনপি প্রার্থী দেবে না বলে মনে হয়।
মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু দীর্ঘদিন ধরেই খুলনার রাজনীতিতে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এখন দলে তাঁর পদ নেই। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি খুলনায় কাউকে প্রার্থী না করলে নজরুল ইসলাম স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন—এমন আলোচনা আছে। এটা হলে বিএনপির বিভক্তি প্রকাশ পাবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
আন্দোলনের সময় ভোট
বিএনপি আগামী মে ও জুনে সরকারবিরোধী আন্দোলন আরও জোরদার করতে পারে—এমন তথ্য আছে সরকারের কাছে। আর এ সময়টাতেই দেশের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিটির মানুষ ভোট উৎসবে মেতে উঠবে। মেয়র ও কাউন্সিলর পদ ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অন্তত দেড় মাস সিটি করপোরেশন এলাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন। এ সময় চাইলেও বিএনপি এসব সিটিতে সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি দিয়ে সুবিধা করতে পারবে না বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে মনে করেন।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত যেকোনো ইস্যুতে আওয়ামী লীগ মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটা উপলক্ষ হয়ে এসেছে। ভোটের আগপর্যন্ত এসব সিটির প্রতিটি থানা-ওয়ার্ড দলীয় নেতা-কর্মীদের পদচারণে মুখর থাকবে। চাইলেও বিএনপি পাঁচ সিটিতে ভোট পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামতে পারবে না।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, ভোট হচ্ছে নিজ দলকে সংগঠিত করা এবং প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করার সহজ পথ। ফলে সিটি করপোরেশনের ভোট বর্জন করে বিএনপি আসলে কিছু অর্জন করতে পারবে না।
সিটির ভোট এককভাবে
আওয়ামী লীগ ১৪-দলীয় জোটের প্রধান শরিক। জাতীয় নির্বাচনে ১৪ দলের অন্যান্য শরিক ও সমমনাদের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচনে অংশ নেয়। জাতীয় পার্টিকেও অনেক আসনে ছাড় দেওয়া হয়।
তবে পাঁচ সিটির নির্বাচন জোটগতভাবে হবে না বলে দলের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। ১৪ দলের শরিকেরাও বলছে, সিটি ভোট নিয়ে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।
১৪ দলের সূত্র বলছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে শরিকদের কোনো প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা কম; বরং কাউন্সিলর পদে শরিকেরা কিছু প্রার্থী দেবে। এ ক্ষেত্রে সমঝোতার সম্ভাবনা খুব কম।
এই বিষয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, সিটি নির্বাচন জোটগতভাবে হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাঁরা নিজেদের মতো করে ভোটে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
একই কথা জানিয়েছেন ১৪ দলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, তাঁরা নিজেদের মতো করে সিটি নির্বাচনে অংশ নেবেন।
এই দুই নেতাই মনে করছেন, পাঁচ সিটির ভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে। আওয়ামী লীগের নেতারাও বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটির নির্বাচন সুষ্ঠু করার চেষ্টা তাঁদের থাকবে।