নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের প্রথম ধাপ ইসি গঠনের পদ্ধতি ঠিক করা। পুরোনো আইনে ইসি গঠন বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব তৈরি করতে কাজ করছে সরকারের গঠন করা কমিশন। তারা কোনো প্রস্তাব দেওয়ার আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের লক্ষ্যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে সরকার। ফলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন উঠেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের প্রথম ধাপ ইসি গঠনের পদ্ধতি ঠিক করা। এটি না করে পুরোনো বিতর্কিত আইনেই ইসি গঠিত হলে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হতে পারে। অনুসন্ধান কমিটি গঠনের আগে সরকারের উচিত ছিল সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করা।
সংস্কার কমিশন যেহেতু প্রস্তাব তৈরির জন্য কাজ করছে, তাই অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তাদের জন্য অপেক্ষা করলে ভালো হতো।এম এ মতিন, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ১০টি কমিশন গঠন করে। এর একটি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এই কমিশন কাজ শুরু করেছে এক মাসও হয়নি। এখন পর্যন্ত তারা ১২টি আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে। এখনো তারা নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন ও বিধিবিধানগুলো পর্যালোচনা করছে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে তাদের প্রস্তাব দেওয়ার কথা।
এর মধ্যে নতুন ইসি গঠনে অন্তর্বর্তী সরকার অনুসন্ধান কমিটি করেছে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন’ অনুসারে। এ আইন সংসদে পাস হয় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। তখন সংসদের ভেতরে-বাইরে এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়। এ আইনে নিয়োগ পাওয়া কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি প্রধান বিষয় হচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি গঠনের বিধান করা। কারণ, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো পদ্ধতি না থাকায় অতীতে বেশির ভাগ নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক ছিল। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ২০২২ সালে যে আইন করেছিল, সেটিও দুর্বল। কারণ, এই আইনে সরকারের পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একটি সূত্র বলেছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে অনুসন্ধান কমিটি করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কমিশনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো মতও নেওয়া হয়নি। নতুন ইসি গঠন নিয়ে সরকারের চিন্তা কী, সেটিও তাদের কাছে পরিষ্কার নয়।
রাজনৈতিক দলগুলোও এ আইনের সমালোচনা করেছিল। এই আইন পাসের আগে একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যসহ বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও গণফোরামের ১২ জন সংসদ সদস্য ৭৬টি সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২২টি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়েছিল, যার সবই ছিল মূলত শব্দগত পরিবর্তন। পদ্ধতিগত পরিবর্তনের কোনো প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও আইনটি বদলানোর পক্ষে। ইতিমধ্যে তারা নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনের একটি নতুন খসড়াও তৈরি করেছে। সেটি সরকারের কাছে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। তবে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করায় এখন সংস্কার কমিশনের এ কাজটি অর্থহীন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সংস্কার কমিশন যেহেতু প্রস্তাব তৈরির জন্য কাজ করছে, তাই অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তাদের জন্য অপেক্ষা করলে ভালো হতো। কিন্তু নির্বাচন করার জন্য সরকারের ওপর একধরনের চাপ আছে। সে কারণেই হয়তো সরকার আগের আইনেই অনুসন্ধান কমিটি করে নির্বাচন কমিশন গঠনের দিকে এগোচ্ছে।আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একটি সূত্র বলেছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে অনুসন্ধান কমিটি করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কমিশনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো মতও নেওয়া হয়নি। নতুন ইসি গঠন নিয়ে সরকারের চিন্তা কী, সেটিও তাদের কাছে পরিষ্কার নয়।
কমিশনের কেউ কেউ মনে করছেন, যেভাবে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেটি সঠিক হয়নি। এটি করার ফলে সংস্কার কমিশনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এতে সংস্কারপ্রক্রিয়া হোঁচট খেতে পারে।
অবশ্য নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেছেন, এখন নির্বাচন কমিশন নেই। কমিশন গঠনের জন্য সরকার অনুসন্ধান কমিটি করতে পারে। যাঁদের নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি করা হয়েছে, তাঁরা সবাই সম্মানিত ব্যক্তি। সঠিক ব্যক্তিরা দায়িত্ব পেলে দুর্বল আইন দিয়েও নির্বাচন কমিশনে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া সম্ভব।
নতুন ইসি গঠনে যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়ের জন্য আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটি গঠন করে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
অনুসন্ধান কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান, বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. নূরুল ইসলাম, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার) এবং পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিন্নাতুন নেছা তাহমিদা বেগম।
এখন নির্বাচন কমিশন নেই। কমিশন গঠনের জন্য সরকার অনুসন্ধান কমিটি করতে পারে। যাঁদের নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি করা হয়েছে, তাঁরা সবাই সম্মানিত ব্যক্তি। সঠিক ব্যক্তিরা দায়িত্ব পেলে দুর্বল আইন দিয়েও নির্বাচন কমিশনে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া সম্ভব।কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার
আইন অনুযায়ী, এই কমিটি নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রতি পদের বিপরীতে দুজন করে ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। চূড়ান্ত নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কার কমিশন যেহেতু প্রস্তাব তৈরির জন্য কাজ করছে, তাই অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তাদের জন্য অপেক্ষা করলে ভালো হতো। কিন্তু নির্বাচন করার জন্য সরকারের ওপর একধরনের চাপ আছে। সে কারণেই হয়তো সরকার আগের আইনেই অনুসন্ধান কমিটি করে নির্বাচন কমিশন গঠনের দিকে এগোচ্ছে।