বিএনপি নয়, দলটির নেতাদের একটা অংশকে বের করে এনে ভোটে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপরতা জোরদার করেছে আওয়ামী লীগ। ৬০ থেকে ৭০ জন নেতাকে লক্ষ্যবস্তু করে নানা মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ জনকে দল থেকে বের করে এনে প্রার্থী করানো সম্ভব হবে বলে আশা করছে ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
সরকার ও আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মূলত তিন ধরনের নেতাদের লক্ষ্য করে তৎপরতা চলছে। এক. বিএনপিতে নিজেদের বঞ্চিত বা অবহেলিত মনে করেন এবং শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি ক্ষুব্ধ এমন নেতা; দুই. ওই সব প্রবীণ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য, যাঁদের এবার নির্বাচন বর্জন করলে পরের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য শারীরিক সামর্থ্য না–ও থাকতে পারে। তিন. জেলা পর্যায়ের কিছু উঠতি নেতাও রয়েছেন, যাঁদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার ব্যাপক আগ্রহ, কিন্তু বিএনপির সঙ্গে থাকলে তাঁদের সেই সম্ভাবনা নেই।
নেতাদের বের করে আনার লক্ষ্যে নানামুখী আশ্বাস বা প্রলোভনের পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে মামলা, গ্রেপ্তার ও বিচারের বিষয়টি সামনে এনে চাপও তৈরি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিএনপি থেকে যাঁদের বের করে আনা সম্ভব হবে, তাঁদের সম্প্রতি নিবন্ধন পাওয়া কয়েকটি দলে ভেড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি। এরই মধ্যে এসব দল ‘কিংস’ পার্টি নামে পরিচিতি পেয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকেও (বিএনএফ) কাজে লাগানোর চিন্তা আছে।
তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের দাবি, ইতিমধ্যে যোগাযোগের মধ্যে এসেছেন, এমন কোনো কোনো নেতা ছোট ছোট বা নামসর্বস্ব দলে যেতে রাজি নন। বরং স্বতন্ত্র নির্বাচন করার বিষয়ে আগ্রহী। কেউ কেউ নতুন দল গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছেন। তবে নতুন দল গঠন করার আগ্রহ যাঁরা দেখাচ্ছেন, তাঁদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের বিশ্বাস কিছুটা কম। কারণ, এঁরা চাপে পড়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তাই নতুন দল গঠনের কথা বলাকে সময়ক্ষেপণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া এখন সারা দেশে যে গ্রেপ্তার অভিযান চলছে, এর মূল উদ্দেশ্য বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ‘ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া’। পাশাপাশি গ্রেপ্তার নেতাদের কাউকে কাউকে ভোটে রাজি করানোর তৎপরতাও চলবে বলে জানা গেছে।
বিএনপির কেউ ভোটে এলে স্বাগত জানাবে আওয়ামী লীগ। কারণ, আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চায়।আব্দুর রাজ্জাক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আ.লীগ
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য নেতাদের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ রাজনৈতিক পর্যায়ে হয়নি। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে আলোচনা করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা বা মন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও আত্মীয়তার সূত্রে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।
আবার সরকারি মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা নতুন দলগুলোর নেতাদের মাধ্যমেও বিএনপির কিছু নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এমন একটি সূত্র জানায়, সরকারি মহল থেকে তাঁদের বলা হয়েছে, বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসা কিছু নেতা ভোটে অংশ নেবেন। কিন্তু এসব নেতা ভোটে এলে কী পাবেন—এটা স্পষ্ট করছে না আওয়ামী লীগ। ফলে চূড়ান্ত কথা বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বলা হচ্ছে, ভোটের খরচ নিয়ে কোনো চিন্তা করা লাগবে না।
এ ছাড়া প্রয়াত নাজমুল হুদার দল তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে শীর্ষ পদ পেয়েছেন বিএনপির সাবেক দুই নেতা—তৈমুর আলম খন্দকার ও সমশের মবিন চৌধুরী। এর বাইরে বিএনএমের নেতৃত্বে আছেন বিএনপির সাবেক দুই নেতা এবং কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, বড় বড় অনেক নেতা তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবেন। এসব নাম এখন প্রকাশ করতে চান না তাঁরা। এখন জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন চলছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অধিকতর অংশগ্রহণমূলক দেখানো এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়াতেই বিএনপি থেকে নেতাদের বের করে আনার চেষ্টা চলছে। এর বাইরে ইসলামপন্থী কিছু দলকে ভোটে আনতেও ভেতরে-ভেতরে তৎপরতা আছে। সূত্রটির মতে, বিএনপির দলছুট, ধর্মভিত্তিক দল, আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ও জাতীয় পার্টিসহ মিত্রদের সব মিলিয়ে ৭০ থেকে ১০০টি পর্যন্ত আসনে ছাড় দেওয়ার চিন্তা আছে। এসব প্রার্থীকে প্রয়োজনে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার চিন্তাও আছে।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলছুটেরা ভোটে দাঁড়ালে ওই সব আসনে আওয়ামী লীগের কাউকে মনোনয়ন না দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা আছে। তবে এটি এখনো চূড়ান্ত নয়। এমন কিছু নেতার সঙ্গে যোগাযোগ চলছে, যাঁরা সুষ্ঠু ভোট হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে যেসব জেলায় বিএনপির প্রভাব বেশি, সেসব এলাকার নেতাদের প্রতি নজর দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ছোট দলগুলোর মধ্যেও কয়েকটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এসব দলের শীর্ষ নেতাকে সংসদ সদস্য করার আশ্বাস দিয়ে ভোটে আনার চেষ্টা আছে।
বিএনপি থেকে বের করে এনে ভোটে দাঁড় করানোর তৎপরতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির সবাই তো চোরাগোপ্তা হামলা, আগুন লাগানোর জন্য রাজনীতি করে না। তাঁদের মধ্যে অনেকেই গণতান্ত্রিক এবং নিজ নিজ জায়গায় জনপ্রিয়। এসব ব্যক্তি যদি নির্বাচন করতে আসেন, অসুবিধা কোথায়? আর তাঁদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের যোগাযোগ থাকা তো অস্বাভাবিক নয়। তাঁর দাবি, আওয়ামী লীগ অঙ্গীকার করেছে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনও আশ্বস্ত করেছে। এর ওপর আস্থা রেখে বিএনপির অনেকেই নির্বাচনে অংশ নেবেন।
আওয়ামী লীগ ও সরকারি সূত্রগুলো বলছে, এক বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। প্রায় সবাই চলমান আন্দোলনের কোনো একটা দুর্বল সময়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে চাইছিলেন। গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের সমাবেশে সংঘর্ষের পর বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বেশির ভাগ কারাগারে। অন্যরা আত্মগোপনে। জেলা পর্যায়েও ধরপাকড় চলছে। এই সময়েকে বিএনপির ‘খারাপ সময়’ বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই এই সময়কে দলটি থেকে নেতাদের ভাগিয়ে আনার তৎপরতা জোরদার হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরাও প্রকাশ্যে বলছেন, বিএনপি থেকে অনেকেই বেরিয়ে আসার জন্য যোগাযোগ করছেন।
গত সোমবার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ ঢাকায় দলের এক সমাবেশে বলেন, অনেকেই লাইন ধরে আছেন তৃণমূলে (তৃণমূল বিএনপি) যোগ দেওয়ার জন্য। আর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মেজর হাফিজের নেতৃত্বে আরও একটি দল হতে যাচ্ছে। তারা শিগগিরই ঢাকায় কনভেনশন করবে। সুতরাং বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও নেতাদের অংশগ্রহণ ঠেকাতে পারবে না।
সরকার ও আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিএনপি থেকে নেতাদের বের করে ভোটে আনার কাজটি একক কোনো রাজনীতিক করছেন না। সরকারের ভেতর থেকে পর্দার অন্তরালে কাজ চলছে। সরকারের দু-একজন মন্ত্রী শেষ মুহূর্তে জানতে পারেন। তবে কেউ পুরো ছকটা জানেন না। তাঁদের যা জানানো হয়, তা জানেন।
ওই সূত্রগুলো বলছে, যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে, তাঁদের একেকজন বা একেক দলকে একেক রকম সুবিধার কথা বলা হচ্ছে। কেউ আর্থিক সুবিধা চাইছেন। তাঁদের সেই আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। কারও লক্ষ্য জনপ্রতিনিধি হওয়া; তাঁদের মাঠের শক্তি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনে সে আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে। মামলা-মোকদ্দমার চাপে থাকা কেউ কেউ যোগাযোগের মধ্যে থাকলেও এখনো দ্বিধায় আছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, দেশে যথাসময়ে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে। হরতাল-অবরোধ দিয়ে বিএনপি নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। বরং তাদের দলের নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে দল ছাড়তে পারেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপির কেউ ভোটে এলে স্বাগত জানাবে আওয়ামী লীগ। কারণ, আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চায়।’