রক্তের দামে কেনা বাংলাদেশ কোনো দেশের প্রভুত্ব মানবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশ যদি মনে করে, আমাদের ওপরে প্রভুত্ব করবে, তাদের জেনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিন সেই প্রভুত্ব স্বীকার করেনি। মোগল আমলে করেনি, ব্রিটিশ আমলে করেনি, পাকিস্তান আমলে করেনি, এখনো করবে না।’
আজ সোমবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা রক্তের দাম দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। কারও দয়ায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি।’ এ প্রসঙ্গে তিনি প্রয়াত গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীরের ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে নয়’, গানটি উদ্ধৃত করেন।
ছাত্র ও যুবসমাজকে সেই বোধ নিয়ে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে ফখরুল বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব নিশ্চয়ই বিষয়গুলো দেখবে, অতীতেও দেখেছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই দেশকে পরাধীন করার ক্ষমতা কারও নেই। এই ভয়াবহ শাসকগোষ্ঠী, যারা নানা নাটক করে, জোর করে ক্ষমতা দখল করে আছে, তাদের একদিন চলে যেতেই হবে।’
এ জন্য জনগণকে নিয়ে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ছাত্র-শ্রমিক, যুবক—সবাইকে মাঠে নামার আহ্বান জানান বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, যারা পুলিশের একটি হুইসেল (বাঁশি), একটি সাউন্ড গ্রেনেডের আওয়াজ শুনে পালাবে না—সেই ধরনের মানসিকতা তৈরি করতে হবে, সেই ধরনের সাহস তৈরি করে দাঁড়াতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দী ইমরান খানের কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমরা পাকিস্তানের নাম শুনলেই সবাই ফুসকে উঠি, অন্যভাবে চিন্তা করি। ইমরান খান দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে তরুণদের মাঠে নিয়ে আসতে হয়। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে নারীদের মাঠে আনতে হয়।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমাদের চেয়ে কম অত্যাচার তাদের ওপরে হয়নি। তারা সেনানিবাসে আক্রমণ করেছিল, তারা মার্কিনদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
পাকিস্তানে এই অবস্থান নিয়ে কেউ কোনো দিন রাজনীতিতে টিকতে পারে না। ইমরান খান জেলে গেছেন, ৩৪ বছর সাজা হয়েছে। তাঁর দুই হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জোর করে দল বদল করা হয়েছে, তার দলের প্রতীক নিয়ে গেছে। তখন তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, নির্বাচনে যাও এবং সেই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঝাঁপিয়ে পেড়েছে সেই তরুণেরা।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনার উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব এর প্রতিবাদ না হওয়ায় ছাত্র ও নারীদের প্রতি হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘এই যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করেছে, আপনারা কী করছেন, আপনারা কী করেছেন। একটা প্রতিবাদ পর্যন্ত করেননি। কোথায় গেল সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কোথায় গেল সেই ছাত্ররা—যারা স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে, ভাষা আন্দোলন করেছে, নব্বইয়ে গণ-অভ্যুত্থান করেছে। কোথায় গেছে তারা।’
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, লক্ষ্য, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন—সব ধ্বংস করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা, ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করা, গণতান্ত্রিক পরিবেশে বাস করা, স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারা, লিখতে পারা, ভিন্নমত পোষণ করতে পারা, রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা—সব তারা কেড়ে নিয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তারা সংবিধানও কাটাছেঁড়া করে শেষ করেছে। এই সংবিধানে এখন তিনটি অনুচ্ছেদ আছে। যে অনুচ্ছেদ আপনি কোনো দিন পরিবর্তন করতে পারবেন না। সেখানে একজন ব্যক্তি, একটি পরিবার ছাড়া আর কিছু নেই। সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনী ব্যবস্থা তুলে নিয়ে আবার এক দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন ফিরিয়ে এনেছে। সেটা করতে গিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে।’
আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে ফখরুল বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা বিরোধী দলকে আসতে দেয়নি। অত্যন্ত সুকৌশলে ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে করেছে। এবার আরও চমৎকার নাটক করে নিজেরা নিজেরা ডামি প্রার্থী খাড়া করে নির্বাচন করেছে। যারা বিরোধী দল (জাতীয় পার্টি) বলে দাবি করে, তাদের আসন বণ্টন করে নির্বাচন করেছে। সেই নির্বাচনকে কেউ গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশে মানুষ গ্রহণ করেনি, আন্তর্জাতিক বিশ্বও গ্রহণ করেনি।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, তাঁর ঘোষণার মধ্য দিয়ে জনগণ স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তিনি কারও নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘আজ ২৫ মার্চ কালরাত। আওয়ামী লীগ অস্বীকার করতে পারে, এই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত চেষ্টা করেছে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা দফারফা করার জন্য। যখন ব্যর্থ হয়েছে, তখন আমাদের তৎকালীন রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউ দেশে থাকেননি। ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আর মূল নেতা আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানে চলে গেছেন। পরে জিয়াউর রহমানের ঘোষণার মধ্য দিয়ে মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বলেই ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে।’
২৯ অক্টোবর গ্রেপ্তার হওয়ার পর সাড়ে তিন মাস কারাবন্দী ছিলেন মির্জা ফখরুল। মুক্তির পর এই প্রথম তিনি সমাবেশে বক্তব্য দিলেন। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল এই সমাবেশের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম)।
হাফিজ উদ্দিন বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে এ দেশের সাধারণ মানুষ, কৃতিত্ব নিতে চায় আওয়ামী লীগ।
যে গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ হয়েছিল, সেই গণতন্ত্রকে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ প্রথম সুযোগেই বিলুপ্ত করে দিয়ে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি আমলে কোনো ভোট কারচুপি ছিল না। ১৯৭৩ সালে মানুষ অবাক হয়ে দেখল, জাতীয় সংসদে কীভাবে ভোট কারচুপি হচ্ছে, কীভাবে প্রার্থী, ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক (ছিনতাই) হচ্ছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন সেই দল আওয়ামী লীগ—তাদের মধ্যে গণতন্ত্রের চেতনা তখনো ছিল না, আজও নেই।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, এখনো দেশে নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়। গত ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে, সেই নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর উন্নত কোনো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসংঘ পর্যন্ত বলেছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এটি কোনো নির্বাচনই না। যেহেতু অবৈধভাবে কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, তাই এই সরকার নিজেদের বৈধ সরকার দাবি করতে পারে না।
বিএনপির নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে উঠবে, সে আন্দোলনে সবাইকে রাজপথে যোগদান করার আহ্বান জানান হাফিজ।
মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ খানের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তৃতা করেন মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান, জয়নাল আবেদীন, বিএনপির ঢাকা মহানগর নেতা ইশরাক হোসেন, রফিকুল আলম প্রমুখ।
সমাবেশ উদ্বোধন করেন বিএনপির স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির সদস্যসচিব ও দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, যুবদলের সুলতান সালাহউদ্দিনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে পেছনে রেখে, ফুটপাতে চেয়ার পেতে এ সমাবেশ করা হয়। সমাবেশের পেছনে একটি কাপড়ের ওপর বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা ছিল ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন করুন’। তবে বক্তাদের কেউ কেউ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও পণ্য বর্জনের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।