একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে বিএনপির দলীয়ভাবে শোক প্রকাশের বিষয়ে নানা আলোচনা চলছে।
কারণ, এর আগে একই অপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের যাঁদের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হয়েছে এবং কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে, তখন নীরব থেকেছে বিএনপি। এমনকি এই অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির দুজন নেতার ব্যাপারেও দলটি শোক প্রকাশ করেনি বা কোনো বক্তব্য দেয়নি।
এখন সামনে জাতীয় নির্বাচন ও এক দফার আন্দোলনের পটভূমিতে কোনো রাজনৈতিক হিাসাব-নিকাশ থেকে বিএনপি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করল কি না, এ বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে।
যদিও বিএনপির নেতারা বলছেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রাজনীতির বাইরে আলেম হিসেবে একটি পরিচিতি আছে, সেটিকে তাঁরা বিবেচনায় নিয়েছেন। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেছেন, রাজনীতির বাইরে আলেম হিসেবে সমাজে একটা অবস্থান তৈরি করেছিলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। আলেম হিসেবেই তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। সে কারণে বিএনপি তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে।
তবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের একটা টানাপোড়েন চলছে অনেক দিন ধরে। সে ক্ষেত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার সময় এবং কারাবন্দী অবস্থায় গোলাম আযমসহ কয়েকজনের মৃত্যুতে বিএনপির নীরবতার বিষয়টি একটা বড় ইস্যু ছিল। এ বিষয় নিয়েই বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াতের বড় অভিযোগ ছিল।
এমনকি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকারে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন আবদুল আলীম। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে আবদুল আলীম কারাগারে মারা যান ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট। তাঁর মৃত্যুতে বিএনপি কোনো শোক প্রকাশ করেনি। একই অপরাধের দায়ে ২০১৫ সালের নভেম্বরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তখনো বিএনপি কোনো বক্তব্য দেয়নি।
এখন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পৃথক শোকবার্তা দিয়েছেন।
যদিও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের শোকবার্তায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দলের পরিচয় বা জামায়াতে ইসলামীর বিষয়টি ব্যবহার করা হয়নি। এ ছাড়া দলটির নেতারা সাঈদীর আলেম পরিচয় ও জনপ্রিয়তার বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলছেন।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বিভিন্ন দল ও জোট নিয়ে বিএনপি এবার আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে চাইছে। এই প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা দলগুলোর বাইরে সরকারবিরোধী অন্য সব দলকে মাঠে নামাতে চাইছে বিএনপি।
অনেক দিনের সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ আন্দোলনে নেই। অতীতে জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে বিএনপিকে যেহেতু দেশের ভেতর ও বাইরে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। সে কারণে বিএনপিও জামায়াতের সঙ্গে একটা দূরত্ব রেখে চলছিল। এমনকি জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে তাদেরকে বাদ দিয়েই বিএনপি যুগপৎ আন্দোলন করছে।
কিন্তু বিএনপির নেতাদের অনেকে তাঁদের আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে জামায়াতের শক্তিকে কাজে লাগানোর পক্ষে। কিছুদিন ধরে জামায়াত আলাদাভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। এখন জামায়াতের এই অবস্থানকে বিবেচনায় নিচ্ছে বিএনপি।
এমন পটভূমিতেই জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব শোকবার্তা দিয়ে থাকতে পারে বলে দলটির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন। তাঁরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে আন্দোলনের বিষয় ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ অন্যতম একটি বিষয় ছিল।
বিএনপির কোনো কোনো নেতা পরিস্থিতিটাকে ব্যাখ্যা করছেন ভিন্নভাবে। তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের দলের ভেতর থেকেই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশের ব্যাপারে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর চাপ ছিল।
এ ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনে থাকা পেশাজীবী সংগঠনগুলোয় জামায়াতের প্রভাব রয়েছে। এসব সংগঠনেরও একধরনের চাপ ছিল। ফলে দলের ভেতরের চাপও কাজ করেছে বিএনপির শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে।
বিএনপির এই অবস্থানকে রাজনৈতিক দিক থেকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে জামায়াত। দলটির কেন্দ্রীয় এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, এটি তাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের দূরত্ব কমাতে সাহায্য করবে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে দুই দলের আবার পাশাপাশি থাকার সুযোগ সৃষ্টি করল বলে জামায়াতের ওই নেতা মনে করেন।