বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপিতে নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তোষ। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নির্বাচনী ব্যয় নিয়েও ক্ষোভ বেড়েছে দুই দলে।
ঢাকার গুলশানে নিজেদের আলিশান কার্যালয়টি ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এই কার্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিল দলটি। ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নতুন নিবন্ধিত দলটির প্রার্থীদের কেউ জিততে পারেননি, বরং একজন বাদে বাকি সবাই জামানত হারান। এর পর থেকে দলটির নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তোষ, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নির্বাচনী ব্যয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন দলটির নেতা-কর্মীরা।
অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পাওয়া আরেক দল তৃণমূল বিএনপিতেও চলছে নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল-অসন্তোষ। নির্বাচনে এই দলেরও সব প্রার্থী জামানত হারান। নির্বাচনে এমন ভরাডুবির জন্য দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে দায়ী করেন দলের প্রার্থীদের একাংশ। পল্টনে তৃণমূল বিএনপির কার্যালয়েও এখন সুনসান নীরবতা।
নির্বাচনের আগে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে আলোচনায় আসে বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের হয়ে বিএনপির বেশ কিছু নেতাকে আনার চেষ্টা ছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ফলে সরকারের কাছেও দল দুটির গুরুত্ব কমে যায়।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরের কাছে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের আলিশান কার্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করে বিএনএম। সেই কার্যালয় থেকেই দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও প্রার্থী বাছাই করা হয়। তখন কার্যালয়ে কিছু নেতা-কর্মীর উপস্থিতি ছিল।
কার্যালয় গুটিয়েছে বিএনএম
নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট ইসির নিবন্ধন পায় বিএনএম। তখন দলটির কার্যালয় ছিল মহাখালীর একটি চারতলা ভবনের চতুর্থ তলায় ছোট দুটি কক্ষে। একটি কক্ষে অফিস, আরেকটি মিলনায়তন। কার্যালয় ছিল ৩৮০ বর্গফুটের।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরের কাছে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের আলিশান কার্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করে বিএনএম। সেই কার্যালয় থেকেই দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও প্রার্থী বাছাই করা হয়। তখন কার্যালয়ে কিছু নেতা-কর্মীর উপস্থিতি ছিল। তবে নির্বাচনের পর এই কার্যালয়ে ছিল সুনসান নীরবতা। নেতা-কর্মীরা না আসায় দিনের অনেকটা সময় কার্যালয় তালাবদ্ধ ছিল।
দলটির বর্তমান ও সাবেক কমিটির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের আগে এই কার্যালয়টি তাড়াহুড়ো করে নেওয়া হয়েছিল। জায়গার মালিকের সঙ্গে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চুক্তি হয়েছিল। মালিকপক্ষ কার্যালয় ছাড়ার নোটিশ দেওয়ায় তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিএনএমের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কলাপসিবল গেট তালা দেওয়া। ভেতরে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবের কক্ষসহ সব কক্ষ ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে কোনো দলের কার্যালয় ছিল, সেটা বোঝার উপায় নেই।
বিএনপিবিহীন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হবে তৃণমূল বিএনপি—দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটির চেয়ারপারসন ও মহাসচিব একাধিকবার এই কথা বলেছিলেন। তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রার্থীও দিয়েছিল ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি।
নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
বিএনএম শুধু কার্যালয় ছেড়েছে এমন নয়, দলটির নেতৃত্ব নিয়েও অসন্তুষ্ট নেতা-কর্মীরা। দলটি নিবন্ধন পাওয়ার তিন মাসের মাথায় দ্বন্দ্বের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। নির্বাচন সামনে রেখে পুরোনো নেতৃত্ব সরিয়ে হুট করেই নতুন নেতৃত্ব সামনে আসে। গত ১৬ নভেম্বর গুলশানে এক নেতার ব্যক্তিগত কার্যালয়ের একটি সভাকে বিএনএমের ‘কাউন্সিল’ বলে দাবি করা হয়। তাতে আগের ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ও জাতীয় স্থায়ী কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
নির্বাচনের আগে দলে যোগ দেওয়া বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরকে বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং মো. শাহ্জাহানকে দলটির মহাসচিব করা হয়। তবে চেয়ারম্যান ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পদসহ অন্যান্য পদ খালি রাখা হয়।
দলটির আগের কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দলটি ছিনতাই করা হয়েছে। নির্বাচন ঘিরে কতিপয় ব্যক্তি টাকাপয়সার লেনদেন করে পুরো দলকে বিতর্কিত করেছে।’ তিনি জানান, তাঁরা এখন দলের নেতৃত্ব বদলাতে চান।
দলের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে দলের কেউ কেউ টাকাপয়সার লেনদেনের অভিযোগ তুলেছেন, তবে তা প্রমাণিত না। তিনি জানান, দলের জন্য গুলশান এলাকাতেই একটি অস্থায়ী কার্যালয় নেওয়া হচ্ছে। পরে পল্টন বা আশপাশের এলাকায় স্থায়ী কার্যালয় করার পরিকল্পনা রয়েছে।
‘তৃণমূল বিএনপিতেও কোন্দল’
তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা। নির্বাচন কমিশনে তৃণমূল বিএনপির নিবন্ধন পাওয়ার পরপরই নাজমুল হুদা মারা যান। গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর দলের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দলটির মূল নেতৃত্বে আনা হয় বিএনপির সাবেক দুই নেতাকে। বিএনপি থেকে পদত্যাগকারী (সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান) শমসের মুবিন চৌধুরী নতুন দলটির চেয়ারম্যান এবং বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত (দলের চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা) তৈমুর আলম খন্দকার হয়েছেন মহাসচিব। নাজমুল হুদার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদাকে দেওয়া হয়েছে নির্বাহী চেয়ারপারসনের দায়িত্ব।
বিএনপিবিহীন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হবে তৃণমূল বিএনপি—দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটির চেয়ারপারসন ও মহাসচিব একাধিকবার এই কথা বলেছিলেন। তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রার্থীও দিয়েছিল ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি। তবে দলটির ১৩৫ প্রার্থীর প্রত্যেকের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
নির্বাচনের আগে থেকেই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তোষ ছিল দলের একাংশের নেতা-কর্মীদের। ভোটে ভরাডুবির পর তাঁরা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে টাকাপয়সা লেনদেনের অভিযোগও তোলেন। বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামেও আলোচনা হয়।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাইরে থেকে লোক এনে দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব পদে বসিয়ে দেওয়া হয়। দলের নেতা-কর্মীরা সন্তুষ্ট ছিল না।’
পল্টনে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তৃণমূল বিএনপির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কোনো নেতা-কর্মী উপস্থিত নেই। নির্বাচনের পর দলের শীর্ষ নেতারা কার্যালয়ে খুব একটা আসেন না।
দলটির ভাইস চেয়ারম্যান সালাম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে টাকাপয়সা নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে, সেটা ঢালাও। দলের কয়েকজন নেতা বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধ নেতা-কর্মীদের উসকানি দিচ্ছেন। তাঁরা দলকে ভাঙার চেষ্টা করছেন।