কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নানাভাবে চাপে রাখতে চাইছে সরকার। ইতিমধ্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজপথ থেকে শ্রেণিকক্ষে নিতে চাপ প্রয়োগ শুরু করেছে সরকার। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান প্রকাশ করছে। সাপ্তাহিক ছুটির পর রোববার অফিস খোলার দিনে সড়ক দখল করে আন্দোলনে নামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শক্তি প্রয়োগের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ে গতকাল বৃহস্পতিবার এক বৈঠকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবিকে যৌক্তিক মনে করে সরকারও কোটাব্যবস্থায় সংস্কারের বিষয়ে ভাবছে। সে ব্যাপারে সরকার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। এর পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশের পরও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখন আর স্বাভাবিকভাবে দেখছে না সরকার।
সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, শুধু দাবি আদায়ের আন্দোলন হলে সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর গত বুধবারই আন্দোলন থেকে সরে যাওয়া উচিত ছিল; কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবারও আন্দোলনকারীরা সড়ক অবরোধ করেছেন। এ থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছেন বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকেরা। এ জন্য যেকোনো মূল্যে আন্দোলন আর বাড়তে না দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
একাধিক মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে কর্মসূচি পালন করছেন। তাঁদের দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়ে সরকার এত দিন ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। এখন সরকার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে এই আন্দোলন মোকাবিলা করার পথে হাঁটতে চাইছে। গতকাল অন্তত চারজন মন্ত্রী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্যে সরকারের কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
গতকাল বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি অব্যাহত রেখে সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি দেখাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, আন্দোলনকারীরা সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে, এমন কর্মসূচি থেকে শিক্ষার্থীদের বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। মন্ত্রীদের বাইরে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে, রাস্তায় কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এরই মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তৎপরতার মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজপথের আন্দোলন থেকে সরানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলেও সরকারের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। সরকার–সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগও তৎপর হয়েছে। প্রথমে চাপ দিয়ে রাজপথ থেকে শ্রেণিকক্ষে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। আজ শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যে এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। কারণ শুরুতেই সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করতে চায় না। তবে রোববারও সড়ক দখল করে আন্দোলনে নামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্তি প্রয়োগ করবে।
তবে গতকাল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় প্রথমবারের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্দোলনকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মারমুখী না হলেও সীমিত শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা ছিল। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানায়। বিকেলে আন্দোলনকারীরা যখন শাহবাগে অবস্থান করছিলেন, সে সময় কাছেই রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান নিয়ে সমাবেশ করে ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে সবুজসংকেত পেয়েই ছাত্রলীগ রাজপথে নেমেছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এত দিন কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে কিছুটা নমনীয় বক্তব্য দিলেও গতকাল কঠোর অবস্থান প্রকাশ করেন। দুপুরে দলের ধানমন্ডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, কোনো অশুভ মহল যদি দেশে অরাজক পরিস্থিতি ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে সরকার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে, এই বক্তব্যকে এখন সামনে আনা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। রাজনৈতিক দিক থেকেও একধরনের চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। তবে এসব কৌশল কতটা ইতিবাচক ফল দেবে, সেই আলোচনাও রয়েছে সরকার ও দলের ভেতরে।