শরিকদের সঙ্গে মতপার্থক্য অনেক, যোগাযোগ বাড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ

শরিকদের সঙ্গে মতপার্থক্য বাড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি—জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর নাখোশ ১৪-দলীয় জোটের শরিক ও মিত্ররা। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে এবং জেলায় জেলায় ১৪ দলের মধ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে শরিকেরা বলছে, জোটগতভাবে সাংগঠনিক তৎপরতা যতই বাড়ুক, সরকারের জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা অব্যাহত রাখবে তারা।

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রথম তিন বছর জোট ও শরিকদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেকটা একলা চলো নীতি অবলম্বন করে। গত মার্চে প্রধানমন্ত্রী ও জোটের প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে পুনরায় জোটকে কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি—নানা বিষয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট শরিক ও মিত্রদের মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার সরকারকে রাখতে ভারতকে অনুরোধসংক্রান্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যে নতুন করে নাখোশ তারা। এ পরিস্থিতিতে জোট ও মিত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

১৪ দলের শরিক ও আওয়ামী লীগের সূত্র জানিয়েছে, সাংগঠনিকভাবে ১৪ দলের তৎপরতা বাড়াতে ঘন ঘন বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর পক্ষ থেকে জেলায় জেলায় চিঠি দিয়ে শরিকদের নিয়ে বৈঠক করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকেও ফোনে শরিকদের নিয়ে কর্মসূচি জোরদার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে আমির হোসেন আমু বলেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে দুই দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। ১৪ দলের শরিকদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে ১৪ দল জেলায় জেলায় কর্মসূচি পালন করবে।

গত আগস্টে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ১৪ দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী। এই বৈঠকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার আগ্রহ দেখান কোনো কোনো শরিক দলের নেতা। এ সময় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বলেন, এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখছেন। ১৪ দলের উদ্বেগ জানানো হবে। এর আগে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে ১৪ দলের বৈঠক হয়। এতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করেন শরিকেরা।

নানা বিষয়ে ১৪ দলের শরিকদের মতপার্থক্য সম্পর্কে জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু প্রথম আলোকে বলেন, ১১৪ দলের বৈঠকে দ্রব্যমূল্যসহ নানা বিষয়ে শরিকেরা তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। আমরা বিশ্ব পরিস্থিতি এবং সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি। তাদের যৌক্তিক উদ্বেগ সরকারকেও জানানো হচ্ছে।’

জোটের একটি শরিক দলের শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা যতই জোটে থাকুন না কেন, জনস্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা অব্যাহত রাখবেন। ওই নেতা বলেন, নির্বাচনে হয়তো ১৪ দল জোটগতভাবেই অংশ নেবে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ে সোচ্চার না হলে তো রাজনীতি করে লাভ নেই। সরকার অতিমাত্রায় আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ জন্য জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত বেশি নিচ্ছে।

১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু

১৪ দলের শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, গুন্ডামি, মাস্তানি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁদের কড়া অবস্থান অব্যাহত থাকবে। এসব বিষয়ে তাঁরা মাঠে লাগাতার কর্মসূচি পালন করবেন। তিনি বলেন, মতপার্থক্য থাকলে আদর্শিকভাবে জামায়াত-বিএনপির মতো জঙ্গি-সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্য আছে। কেন্দ্রীয়ভাবে এবং তৃণমূলে ১৪ দলের সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচন এগিয়ে এলে ১৪ দলের শরিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ, ১৪ দলের শরিকদের হাতে আওয়ামী লীগের বিকল্প খুব বেশি কিছু নেই। আর আওয়ামী লীগও ১৪ দলের শরিকদের স্বাভাবিক মিত্র মনে করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মার্চে ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে জানান, জোট থাকবে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নেবেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং বিশ্বব্যাপী মন্দাভাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোট শরিকদের আরেকবার ডেকে কথা বললে জোটে মতপার্থক্য হয়তো কমবে।

জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের

তবে ক্ষমতাসীনদের দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে দূরত্ব খুব একটা কমেনি। দলগতভাবে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগাযোগ এখন খুবই নগণ্য। সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে আওয়ামী লীগ। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর এর প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ করে জাতীয় পার্টি। দলটির নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, নিজেদের কর্মী বাহিনীকে নানা ইস্যুতে মাঠে নামিয়ে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে চান তাঁরা। কারণ, গত এক যুগে জাতীয় পার্টি মাঠের রাজনীতিতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। নির্বাচনের আগে দর-কষাকষি করতে হলে দলের উপস্থিতি জানান দিতে হবে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, জাতীয় পার্টিকে এভাবে মান ভাঙানো যাবে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা। কারণ, দলটি বেশ সুযোগসন্ধানী। রাজনৈতিক সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখে তারা শেষ কথা বলবে। এ ছাড়া তাদের বাগে আনতে চাইলে চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ করতে হবে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৪ সাল থেকে প্রগতিশীল দল নিয়ে ১৪-দলীয় জোটগতভাবে নানা আন্দোলনে ছিল। ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ২০০৯ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সরকারেও অংশীদারত্ব ছিল ১৪ দলের শরিকদের।

জাতীয় পার্টি ১৯৯৬ সালের পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের থেকেছে, মিত্র হিসেবে সমর্থন দিয়েছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনের পর তাদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়নি। এরপর জোট ও মহাজোট অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাঁদের সামাজিক, সাধারণ যোগাযোগ আছে। তবে মিত্র বা সঙ্গী হিসেবে যে রাজনৈতিক যোগাযোগ কিংবা সমঝোতার কোনো তৎপরতা নেই। তিনি বলেন, সরকার সাম্প্রতিক সময়ে অনেক অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। এর প্রতিবাদ তাঁরা মাঠে-ময়দানে চালিয়ে যাবেন।