আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সরকারবিরোধী প্রধান দল বিএনপির অধিকাংশ নেতা এবার নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ঈদ করছেন। সরকারি পক্ষের নেতারা জনগণকে নির্বাচনমুখী হওয়ার বার্তা দিচ্ছেন, অন্যদিকে বিএনপির নেতারা জনগণকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। এই বিপরীতমুখী দুই বার্তা নিয়েই নেতারা ঈদকেন্দ্রিক গণসংযোগ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন।
চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের শুরুতে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান দুই মেরুতে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ, দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বেশ কিছু দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে আন্দোলন হচ্ছে। ঈদের পর আন্দোলন আরও জোরালো করার ঘোষণাও দিচ্ছে বিরোধীরা।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগে ঈদ জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সরকারি পক্ষ এলাকায় নির্বাচনী প্রস্তুতির বার্তা দিচ্ছে। দলের নেতা-কর্মীদের জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি জনগণকে নির্বাচনমুখী করতে প্রচার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে বিএনপির নেতারা জনগণকে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করছেন। দুই দলই ঈদকে কেন্দ্র করে তৃণমূলকে চাঙা করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
সরকারি দলের নেতারা ভোটারদের কাছে নিজেদের তুলে ধরতে এবারের ঈদকে বেছে নিয়েছেন। এই তালিকায় বর্তমান সংসদ সদস্যরা যেমন রয়েছেন, পাশাপাশি এলাকাবাসীর কাছে নিজেকে মেলে ধরতে ছুটছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী তরুণ নেতারাও। ঈদকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রার্থিতার বিষয়টি জানান দেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা ভোটারদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরকারি দলের অনেক নেতা সদ্য বিদায়ী রমজান মাসে ইফতারসামগ্রী বিতরণ, ইফতার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ নিয়মিতভাবে নির্বাচনী এলাকায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় তাঁরা ঈদের দিনেও নির্বাচনী এলাকার গিয়ে ঈদের জামাত আদায়সহ জনগণের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ঈদে নিজ এলাকা নেত্রকোনার পূর্বধলায় গেছেন। সেখান থেকে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নেতা-কর্মীদের আগামী নির্বাচনে নৌকার ভোট বাড়াতে কাজ করতে বলা হচ্ছে। আরও বেশি করে মানুষের কাছে যেতে বলা হচ্ছে। জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার কথা তুলে ধরছেন নেতারা। আগামী নির্বাচনে তাঁরা যেন নৌকায় সমর্থন অব্যাহত রাখেন, সেই অনুরোধ করছেন। এবারের ঈদে এটিই দলের মূল বার্তা।
এবারের ঈদে দলের নেতাদের এলাকায় গিয়ে করণীয় বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বুধবার ধানমন্ডিতে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলীয় নেতাদের সঙ্গে ভিডিও কলে যুক্ত হয়ে তিনি এসব নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী ঈদের ছুটিতে জনসংযোগের পাশাপাশি সরকারি প্রকল্পের উপকারভোগীদের খোঁজখবর নিতে বলেন। নেতা-কর্মীদের গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে যেতে বলেন, বিশেষ করে সরকারের উন্নয়নের চিত্র মানুষের কাছে তুলে ধরার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে বিএনপি আমলের অপশাসন-দুর্নীতির চিত্র এবং পার্থক্য মানুষের সামনে তুলে ধরার কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা মেনে নির্বাচন সামনে রেখে এবারের ঈদকে তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর ভালো উপায় হিসেবে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। ঈদের জামাতে অংশ নেওয়াসহ গরিবদের মধ্যে খাবার বিতরণ, ঈদের আগে বস্ত্র বিতরণও করেছেন। তাঁরা বর্তমান সরকারের উন্নয়নের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরে আওয়ামী লীগকে পুনরায় নির্বাচিত করতে অনুরোধ করছেন।
ঈদ করতে নিজের এলাকায় গেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ঈদের আগে একাধিক সামাজিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। ঈদের দিন সকালে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করেন তিনি। এ সময় তিনি সরকারের পক্ষ থেকে সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান। এরপর তিনি দিনভর শান্তিগঞ্জ উপজেলার নিজ বাড়িতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
ঈদ ঘিরে তৃণমূলের নেতা-কর্মী ও জনগণকে কী বার্তা দিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, হাওর এলাকার মানুষ এবার খুবই খুশি। একদিকে ঈদ, অন্যদিকে বোরো ফসল গোলায় তোলার আনন্দ। মানুষ স্বস্তিতে আছে, আনন্দে আছে। তিনি বলেন, ‘মানুষ সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে খুশি। মানুষ আরও উন্নয়ন চায়। আমাদের বার্তা হচ্ছে, এই উন্নয়ন-অগ্রগতি ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই।’
আওয়ামী লীগের নেতারা নির্বাচনমুখী হলেও বিএনপির নেতারা বার্তা দিচ্ছেন জোরালো আন্দোলনের। বিএনপির নেতারা বলছেন, ঢাকায় ঈদ না করে নিজ নিজ এলাকায় যেতে দলের নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঈদকে কেন্দ্র করে নিজ এলাকায় হামলা-মামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে বলা হয়েছে। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ঈদ করার পাশাপাশি ঈদ-পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে সাংগঠনিক কর্মকৌশল ঠিক করার নির্দেশনা রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এবারের রমজান মাস বিএনপির জন্য ব্যতিক্রম ছিল। ইফতার পার্টি, সংবাদ সম্মেলন, অবস্থান কর্মসূচির মতো নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে আন্দোলন চলমান ছিল। রোজার পরে স্বাভাবিক সময়ে আরও কর্মসূচি আসবে। ঈদের সময়ে নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিষয়ে বলা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্বাচনী বার্তার বিষয়ে আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা কাকে এসব বার্তা দিচ্ছেন? জনগণ তো নির্বাচনকেন্দ্রিক নন, আন্দোলনমুখী। তাঁরা বিএনপির নেতৃত্বে চলমান আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। নিজেদের ভোটাধিকার ফেরত পেতে মানুষ বিএনপির সঙ্গে আছেন, এটি প্রমাণিত।
বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির প্রতিবাদ, সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপি ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে। কখনো বিভিন্ন দল ও জোটকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎভাবে, কখনো এককভাবে নানা কর্মসূচি করছে। রোজার পর নতুন কী কর্মসূচি আসবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। তবে দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এবার ঈদের পর নতুন যে যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে, তা আগের কর্মসূচিগুলোর চেয়ে আরও জোরালো ও শক্তিশালী হবে। ঈদকেন্দ্রিক কুশল বিনিময়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ভবিষ্যৎ আন্দোলন কর্মসূচিতে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিষয়ে সচেষ্ট হতে বলছেন বিএনপির নেতারা।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ ময়মনসিংহের নিজ এলাকায় গেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দলের নেতারা আন্দোলনের বার্তা নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় গেছেন। চূড়ান্ত আন্দোলনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের। সাধারণ মানুষ দুঃসহ অবস্থায় রয়েছে। সামর্থ্য অনুযায়ী, জনগণের পাশে এবং জেলে থাকা নেতা-কর্মীদের পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন নেতারা। তিনি বলেন, বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিতে মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। ঈদকে কেন্দ্র করে জনগণকে আরও উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
দুই বড় রাজনৈতিক দলের এসব বার্তা জনগণ কীভাবে নিচ্ছে, তা সময়ই বলে দেবে। রাজনৈতিক কারণে দেশে যেন অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি না হয়, সেটিই সাধারণ মানুষের চাওয়া।