বিএনপি–জামায়াত: টানাপোড়েন কমলেও যুগপৎ কর্মসূচিতে এখনই নয়

সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতকে এড়িয়ে চলার যে কৌশল নিয়ে বিএনপি এগোচ্ছিল, রাজনৈতিক নানা হিসাব-নিকাশ থেকে সে অবস্থানেই আছে দলটি।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে দলীয়ভাবে শোক প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর দূরত্ব কিছুটা কমেছে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতকে এড়িয়ে চলার যে কৌশল নিয়ে বিএনপি এগোচ্ছিল, এখনো সে অবস্থানেই আছে দলটি। আবার জামায়াতও নিজেদের মতো করে আন্দোলন-কর্মসূচি করছে।

তবে সাঈদীর মৃত্যুর পর নতুন করে তৈরি হওয়া প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক আবার রাজপথে গড়াবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। দল দুটির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনো বৈঠক বা আলোচনা হয়নি। ফলে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াত যুক্ত হবে কি না, সেটি স্পষ্ট নয়।

যদিও বিএনপি ও জামায়াত—দুটি দলেরই আন্দোলনের লক্ষ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো। কিন্তু রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশে এবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতকে এড়িয়ে চলছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া হয়। এই জোট ভেঙে নতুন একাধিক জোট হলেও সেসব জোটে নেই জামায়াত।

জনগণ চায় সব বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধভাবে এই সরকারের পতন ঘটাক। সে জন্য যাদের ভূমিকা নেওয়া উচিত, যারা ক্ষমতাপ্রত্যাশী দল—সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তাদেরই ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর একজন কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল

যুগপৎ আন্দোলন ও এর কর্মসূচি নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো আলোচনাও করেনি বিএনপি। এ নিয়ে জামায়াতের অভিমান ছিল। তবু জামায়াত নিজে থেকেই যুগপৎ আন্দোলনের শুরুর দিকে কর্মসূচিতে ছিল। কিন্তু দলের আমিরকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিএনপি বিবৃতি না দেওয়ায় জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন থেকে সরে যায়।

এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর একজন কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জনগণ চায় সব বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধভাবে এই সরকারের পতন ঘটাক। সে জন্য যাদের ভূমিকা নেওয়া উচিত, যারা ক্ষমতাপ্রত্যাশী দল—সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তাদেরই ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৪ আগস্ট রাতে মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে বিএনপি দলীয়ভাবে শোক প্রকাশ করে। যদিও একই অপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতার ফাঁসি এবং কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যু হলেও বিএনপি তখন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এক দফার আন্দোলন এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক হিাসাব-নিকাশ থেকে বিএনপি সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে বলে আলোচনা রয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীর উচ্চপর্যায়ের নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, কার্যত ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে জামায়াতকে এড়িয়ে চলার যে কৌশল নিয়েছে বিএনপি, মূলত একটি দেশকে সন্তুষ্ট রাখার ইচ্ছা থেকে দলটির নেতৃত্ব এই কৌশল নিয়েছে।

অবশ্য বিএনপির নেতারা বলছেন, তাঁরা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে রাজনীতির বাইরে একজন প্রখ্যাত আলেম এবং ইসলামি পণ্ডিত হিসেবে বিবেচনা করেন। সে জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের শোকবার্তায় সাঈদীর দলীয় পরিচয় বা জামায়াতের নাম ব্যবহার করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে বিএনপি একটা কৌশল নিয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীর উচ্চপর্যায়ের নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, কার্যত ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে জামায়াতকে এড়িয়ে চলার যে কৌশল নিয়েছে বিএনপি, মূলত একটি দেশকে সন্তুষ্ট রাখার ইচ্ছা থেকে দলটির নেতৃত্ব এই কৌশল নিয়েছে। জোট ভেঙে দেওয়া, জামায়াতের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ ছিন্ন করা ওই কৌশলেরই অংশ। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি এই কৌশল নিয়েছে, তা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি।

জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক, মধ্যপন্থা অনুসরণকারী দল। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ অন্যায় এবং অজ্ঞতাপ্রসূত ভুল ধারণার ভিত্তিতে বসে আছে। তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তা, হস্তক্ষেপ এবং একটি দলকে অন্ধভাবে সমর্থন করার বিষয়টি আঞ্চলিক নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করবে বলে মনে করি।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের

বরং শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের কূটনৈতিক বার্তা সম্পর্কে ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিএনপিতে চরম অস্বস্তি তৈরি করেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াতসহ সব মহলের মধ্যে যখন একটা ঐক্যপ্রক্রিয়া কাছাকাছি আসছিল, ঠিক তখন সেটাকে নস্যাৎ করা এবং বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে সংবেদনশীলতা সৃষ্টির জন্য ভারতের গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর প্রকাশ হয়েছে।

এ বিষয়ে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা কথা বলতে রাজি হননি। তবে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক, মধ্যপন্থা অনুসরণকারী দল। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ অন্যায় এবং অজ্ঞতাপ্রসূত ভুল ধারণার ভিত্তিতে বসে আছে। তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তা, হস্তক্ষেপ এবং একটি দলকে অন্ধভাবে সমর্থন করার বিষয়টি আঞ্চলিক নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করবে বলে মনে করি।’

জামায়াতের নেতারা বলছেন, তাঁরা মনে করেন, জামায়াতসহ ইসলামপন্থীদের সঙ্গে প্রকাশ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর সম্ভাবনা খুব একটা নেই বিএনপির। ফলে বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করে বা ঘোষণা দিয়ে জামায়াতের যুগপৎ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সুযোগ কম। এ ক্ষেত্রে জামায়াত একই দিনে, অভিন্ন দাবিতে আলাদা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকতে পারে।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলমান ধারাবাহিক কর্মসূচি প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করে জনগণের প্রত্যাশার আলোকেই ভূমিকা পালন করবে জামায়াত।’

তবে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বিভিন্ন দল ও জোট নিয়ে বিএনপি এবার আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে চাইছে। এই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের বাইরে সরকারবিরোধী অন্য সব দলকেই মাঠে নামার আহ্বান জানিয়েছে দলটি।