সরকারি সুবিধাসহ দলীয় রাজনীতি করা নিয়ে প্রশ্ন

মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদ থেকে ৩ জানুয়ারি অবসরে যাওয়া কবির বিন আনোয়ার আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন।

সামনে এসেছে জনপ্রশাসনের শীর্ষ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব থেকে মাত্রই অবসরে যাওয়া কবির বিন আনোয়ারের দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ঘটনা
ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে, একজন সরকারি কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার তিন বছরের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। তবে রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার বিষয়ে কিছু বলা নেই।

অন্যদিকে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর রাজনীতি করা যাবে কি না, এ বিষয়ে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-তে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। এসব বিষয় নতুন করে সামনে এসেছে জনপ্রশাসনের শীর্ষ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব থেকে মাত্রই অবসরে যাওয়া কবির বিন আনোয়ারের দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ঘটনাটি।

মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদ থেকে ৩ জানুয়ারি অবসরে যাওয়া কবির বিন আনোয়ারকে আওয়ামী লীগে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো পদ বা দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তবে দলীয় কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন তিনি। গতকাল শুক্রবারও আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ কমিটি এবং মেয়রদের যৌথ সভায় অংশ নিয়েছেন।

যে ব্যক্তি সরকারি বেতন-ভাতা ও সুবিধা ভোগ করছেন, তিনি কীভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেন?
শাহদীন মালিক, বিশিষ্ট আইনজীবী

এই সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মাঝখানে বসেন। তাঁর এক পাশে বসেন শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি। অন্য পাশে তথ্যমন্ত্রী ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। এরপরই কবির বিন আনোয়ার বসেন। কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা চারকোনা টেবিলের অন্য পাশে বসেন।

বৈঠকের পর সাংবাদিকেরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে জানতে চান, কবির বিন আনোয়ার আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান হচ্ছেন—এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এর জবাবে তিনি বলেন, ‘নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) তাঁকে (কবির বিন আনোয়ার) অফিসে নিয়মিত বসতে বলেছেন। নিশ্চয়ই তাঁকে কোনো বিশেষ দায়িত্ব দেবেন। কী দায়িত্ব দেবেন, এখনো আমি জানি না। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তাঁকে দায়িত্ব দিলে জানতে পারবেন। এত তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।’

কবির বিন আনোয়ার

এর আগে গত বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় কবির বিন আনোয়ার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানান দলের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক সেলিম মাহমুদ এবং দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। পরে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গেও দেখা করেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান প্রয়াত এইচ টি ইমাম যে কক্ষে বসতেন, সেই কক্ষে সেদিন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কো-চেয়ারম্যানের চেয়ারে কিছুক্ষণ বসেন তিনি।

দলীয় সূত্র বলছে, অবসরে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন কবির বিন আনোয়ার। সদ্য সাবেক এই আমলাকে দলের নির্বাচনসংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

এরপরই তিনি আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে যাতায়াত শুরু করেন। আলোচনা আছে, তাঁকে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক বা কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। এই কমিটির চেয়ারম্যান দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচনে কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন এইচ টি ইমাম। এই কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

কবির বিন আনোয়ার গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নেত্রী (আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা) কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়েছেন আমাকে। কাজটি মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক। এ জন্য আমি আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে বসছি। এর বাইরে এখন আর বিশেষ কিছু বলতে চাই না।’ তবে তিনি জানান, তাঁর বাবা সক্রিয় রাজনীতি করতেন। তিনি নিজেও ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

কতটা নৈতিক, উঠেছে সে প্রশ্নও

তবে সব ধরনের সরকারি সুবিধা নিয়ে অবসরে যাওয়া মাত্রই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া কতটা নৈতিক—সে প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে উঠেছে। নিয়ম অনুযায়ী, কবির বিন আনোয়ার অবসরে যাওয়ার পর এক বছর অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) ভোগ করবেন। পিআরএলে থাকা অবস্থায় সরকারি চাকরিজীবীরা তাঁদের ছুটি চলাকালীন ১২ মাস মূল বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ অন্যান্য প্রাপ্য পেয়ে থাকেন। ছুটি শেষে পেনশন-গ্র্যাচুইটি পান। সরকারি সুবিধা নেওয়া অবস্থায় একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়া কতটা নৈতিক, মূলত সেই প্রশ্নই সামনে এসেছে।

২০১৫ সালের আগে সরকারি কর্মকর্তারা অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে বা এলপিআরে (লিভ প্রিপারেশন ফর রিটায়ারমেন্ট) যেতেন। ২০১৫ সালে এর নাম হয় অবসর–পরবর্তী ছুটি বা পিআরএল (পোস্ট রিটায়ারমেন্ট লিভ)। সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ অনুসারে, ‘চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর চুক্তিভিত্তিক কর্মরত থাকা ব্যতীত, কোনো ব্যক্তির, বৈদেশিক বা বেসরকারি চাকরি বা কোনো প্রকল্পে চাকরি গ্রহণ, অন্য কোনো পেশা গ্রহণ, ব্যবসা পরিচালনা এবং বিদেশ যাত্রার জন্য সরকার বা কর্তৃপক্ষের অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হবে না। তবে শর্ত থাকে যে সরকার বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ, কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে, অনুরূপ ভিন্ন চাকরি বা পেশা গ্রহণ, ব্যবসা পরিচালনা বা বিদেশ যাত্রা বারিত করে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারবে।’

কবির বিন আনোয়ারের বাবা আনোয়ার হোসেন ছিলেন সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের দুবারের সাধারণ সম্পাদক। আর কবির বিন আনোয়ার অবসরের পর সিরাজগঞ্জ সদর আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন—এই আলোচনা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই আছে।

নিরুৎসাহিত করেছে আইন

কবির বিন আনোয়ার ১৯৮৮ সালে সহকারী কমিশনার হিসেবে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ২০১৮ সালে জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। সেখান থেকে তাঁকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব দেয় সরকার। তিনি মাত্র ১৯ দিন এই পদে ছিলেন। তাঁর মতো এত কম সময়ের জন্য এর আগে কেউ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করেননি।

অবসরে গিয়েই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে কবির বিন আনোয়ারের যুক্ত হওয়ার বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা অবসরের তিন বছরের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না—জাতীয় সংসদ এই আইন পাস করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, আমলাদের রাজনীতিতে না আসার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের মতোই রাজনীতিতেও অংশ নেওয়ার ব্যাপারে প্রকারান্তরে নিষেধই করা হয়েছে। এ ছাড়া সদ্য অবসরে যাওয়া মন্ত্রিপরিষদ সচিব, যিনি আগে জ্যেষ্ঠ সচিব ছিলেন, এমন একজন সর্বোচ্চ পর্যায়ের আমলা একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া ওই দলটি নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা পেতে পারে, যা কাম্য নয়।

পিআরএলে যাওয়ার পরই রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াকে বেআইনিও মনে করেন আইনজীবী শাহদীন মালিক। তাঁর মতে, যে ব্যক্তি সরকারি বেতন-ভাতা ও সুবিধা ভোগ করছেন, তিনি কীভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেন? এটা আইন সমর্থন করে না। তিনি বলেন, আইনের সবকিছু সাদা-কালো এভাবে লেখা সম্ভব নয়। তাহলে আইন করতে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লাগবে। আইনের ধ্যানধারণায় পিআরএলে থাকা একজন আমলার রাজনীতি করাকে সমর্থন করে না।