নির্বাচনী আচরণবিধি বেশি লঙ্ঘন করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। নির্বাচন কমিশনের গঠন করা নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটিগুলো এখন পর্যন্ত ২১১টি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের কারণ দর্শানোর নোটিশ বা চিঠি দিয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ৯১ জন। আবার তাঁদের মধ্যে ৫২ জনই বর্তমান সংসদ সদস্য।
১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে বিভিন্ন সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী–সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। গত ৫ দিনে ৩৬টি স্থানে হামলা ও সংঘর্ষ হয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায় হামলা হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মীদের ওপর।
আওয়ামী লীগের যেসব প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ বা চিঠি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৫২ জন বর্তমান সংসদ সদস্য। এ ছাড়া ২৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাতীয় পার্টির ৯ প্রার্থীকেও শোকজ করা হয়েছে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে জেল-জরিমানার পাশাপাশি প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতা রাখে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের সতর্ক করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে জরিমানা করা হয়েছে।
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য এখন মাঠে আছেন প্রায় ৮০০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ ছাড়া ‘ভোটপূর্ব অনিয়ম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত’ করার জন্য জুডিশিয়াল (বিচারিক) ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে প্রতিটি আসনে একটি করে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি রয়েছে। তারাও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করতে পারে। তবে তারা নিজেরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কমিটিগুলো ইসিকে সুপারিশ করতে পারে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারে। কমিশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা দলকে ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা জরিমানা করতে পারে বা প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে জেল-জরিমানার পাশাপাশি প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতা রাখে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের সতর্ক করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে জরিমানা করা হয়েছে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে কেউ নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং রাজনৈতিক দল কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান আছে। মূলত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এটি করে থাকেন।
নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান প্রথম আলোকে বলেন, আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করার জন্য সব রিটার্নিং অফিসারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আচরণবিধি মেনে চলা হচ্ছে কি না বা কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি মাঠে কাজ করছে। অনেক ক্ষেত্রে জরিমানা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দু–একটি ক্ষেত্রে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইসি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে, এটি চলমান প্রক্রিয়া বলে জানান নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান। তিনি বলেন, শৈলকুপা, বেনাপোল ও রাজশাহীসহ যেসব এলাকায় বিচ্ছিন্ন সহিংসতা হয়েছে সেখানকার রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারদের কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। শনিবার (আজ) প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে এসব ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
যে চারজনকে সতর্ক করা হয়েছিল, তাঁরা হলেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, ঢাকা-১৯ আসনের প্রার্থী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাশ ও গাজীপুর-৫ আসনের প্রার্থী মেহের আফরোজ।
তফসিল ঘোষণার পর থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত অন্তত ২১১টি অভিযোগ আমলে নিয়েছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটিগুলো। প্রার্থীর পাশাপাশি তাঁদের অনুসারী নেতা–কর্মী–সমর্থক এবং কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। কারও কারও বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগও রয়েছে। আওয়ামী লীগের যেসব প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ বা চিঠি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৫২ জন বর্তমান সংসদ সদস্য। এ ছাড়া ২৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাতীয় পার্টির ৯ প্রার্থীকেও শোকজ করা হয়েছে। এসব অভিযোগের তদন্ত শেষে কমিটিগুলো ইসিতে প্রতিবেদনও পাঠাতে শুরু করেছে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন আসন থেকে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির ১২০টির বেশি প্রতিবেদন ইসি পেয়েছে। প্রথমবার যারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন, তাঁদের সতর্ক করার সুপারিশ করা হয়েছে। কিছু প্রার্থীকে ইসিতে তলব করা হবে। নির্বাচন কমিশনাররা এখন ঢাকার বাইরে আছেন। তাঁরা ফিরলে আগামী সপ্তাহ থেকে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের তলব করার কার্যক্রম শুরু হবে।
একজন সাংবাদিকের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠার পর কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ ক ম বাহাউদ্দিনকে গতকাল কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে অনুসন্ধান কমিটি। গত বুধবার এই সংসদ সদস্যের নির্দেশে তাঁর অনুসারীরা বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদক ও ক্যামেরাপারসনের ওপর হামলা চালান বলে অভিযোগ ওঠে। বাহাউদ্দিনকে সশরীর অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে অনুসন্ধান কমিটির সামনে আগামীকাল রোববার হাজির হতে বলা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চয়ন ইসলামকেও আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনায় সশরীর অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে অনুসন্ধান কমিটির সামনে আগামীকাল রোববার হাজির হতে বলা হয়েছে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ইসি অনেক কিছুই করতে পারে। যেসব প্রার্থী বারবার আচরণবিধি লঙ্ঘন করবেন, তাঁদের প্রার্থিতা বাতিল করা উচিত।সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন
প্রথম আলোর লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে লালমনিরহাট-১ (হাতীবান্ধা-পাটগ্রাম) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান প্রধানের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা হয়। তাঁর গণসংযোগে বাধা এবং তাঁর গাড়ি ও নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এ ঘটনায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে গতকাল হাতীবান্ধার গড্ডিমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে শ্যামলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে লালমনিরহাট-১ আসনের নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি। আবু বক্কর ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোতাহার হোসেনের ব্যক্তিগত সহকারী।
নৌকার বাইরে গিয়ে কেউ কোনো কথা বললে ‘গলা নামিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মাদারীপুর-২ (রাজৈর-সদর একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খানের বড় ছেলে আসিবুর রহমান খান। তাঁর এমন বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি।
জামালপুর-৫ (সদর) আসনে সরকারি ভাতাভোগী ব্যক্তিরা নৌকার প্রার্থীর সভায় অংশ না নিলে নির্বাচনের পর ভাতার কার্ড বাতিলের হুঁশিয়ারি দেওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা হাতেম আলীকে গতকাল কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি।
ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, অনুসন্ধান কমিটিগুলো কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রার্থীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে বরগুনা–১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথের (শম্ভু) বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে অভিযোগ দায়ের করার জন্য সুপারিশ করেছে অনুসন্ধান কমিটি। আরেকটি ঘটনায় শম্ভু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুজন নেতাকে অর্থদণ্ড করার সুপারিশ করেছে কমিটি। এ ছাড়া পাবনা–৩ আসনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার বিরুদ্ধে, গাজীপুর–৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মেহের আফরোজের একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী মাজেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করেছে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি।
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের চার প্রার্থীকে সতর্ক করেছে ইসি। ‘ভবিষ্যতে আচরণবিধি প্রতিপালন করার শর্তে’ তাঁদের সতর্ক করা হয়। যে চারজনকে সতর্ক করা হয়েছিল, তাঁরা হলেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, ঢাকা-১৯ আসনের প্রার্থী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাশ ও গাজীপুর-৫ আসনের প্রার্থী মেহের আফরোজ। অন্যদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাখ্যা দিতে গত শুক্রবার ঝালকাঠি-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আমির হোসেন আমুকে ইসিতে তলব করা হয়। অবশ্য তাঁর বক্তব্যে ইসি সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
মাঠে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কিছু ক্ষেত্রে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় জরিমানা করেছেন। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে লক্ষ্মীপুরে তিনটি নির্বাচনী আসনে চারজন প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মোট ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এর আগে গত বুধবার কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় নৌকার এক কর্মীকে (তিনি ইউপি সদস্য) এক দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ইসি অনেক কিছুই করতে পারে। যেসব প্রার্থী বারবার আচরণবিধি লঙ্ঘন করবেন, তাঁদের প্রার্থিতা বাতিল করা উচিত।