জোটসঙ্গী–মিত্রদের আসনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন

আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ

ঢাকার নারায়ণগঞ্জ ও কুষ্টিয়ার দুটি আসন বাদ রেখে ২৯৮টি আসনে দলীয় মনোনয়নের তালিকা প্রকাশ করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তাতে বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনে দলটির জোটসঙ্গী ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র দল—কারও জন্যই আসন খালি রাখা হয়নি।

এমনকি জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননের আসনও বাদ যায়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটি আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত মনোনয়ন তালিকা নয়। একক নির্বাচনের প্রস্তুতি থেকে এই তালিকা। ফলে এই তালিকায় নাম আসা অনেকের মনোনয়ন শেষ মুহূর্তে রদবদল হতে পারে। কারণ, এবার আওয়ামী লীগ এখনো আগামী সংসদ নির্বাচনের কৌশল চূড়ান্ত করেনি। কারও সঙ্গে আসন ভাগাভাগি বা সমঝোতা হয়েছে, এমন তথ্যও প্রকাশ পায়নি।

জাতীয় পার্টিও এককভাবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিচ্ছে। আজ তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাপা গোপালগঞ্জের দুটি আসন বাদ রেখে ২৯৮ আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো জানিয়েছে, দু-এক দিনের মধ্যে দলের নির্বাচনী কৌশল ঠিক হবে। প্রধান বিরোধী বিএনপি নির্বাচনের বাইরে। ফলে শেষ পর্যন্ত কয়টা দল নির্বাচনে আসে, কারা কোথায় প্রার্থী হয়, সেটি দেখে নির্বাচনী কৌশল ঠিক করা হবে। এরপর ১৪–দলীয় জোটসহ পুরোনো মহাজোটের শরিক এবং রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে ভেতরে-ভেতরে সমঝোতা হতে পারে। তখন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী তালিকার অনেকে বাদ পড়তে পারেন।

বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রয়াত এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা), রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা, সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর তরীকত ফেডারেশন ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (জেপি) ৩৩টি আসনে জিতেছিল।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে তারা জয়ী হয়েছিল বলে পাঁচ বছর ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে। এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল না বলেও সমালোচনা রয়েছে। এবার বিএনপিবিহীন নির্বাচনে সে রকম সমঝোতার গুঞ্জন আছে।

আমরাও ৩০০ আসনে প্রার্থী ঠিক করেছি। কাল (আজ সোমবার) পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের তালিকা প্রকাশ করবেন। এরপর দেখা যাক কী হয়।
জাপার কো–চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ

গত নির্বাচনে সমঝোতার মাধ্যমে জাপার জ্যেষ্ঠ নেতা রওশন এরশাদসহ ২৩ জন, রাশেদ খান মেননসহ ওয়ার্কার্স পার্টির ৩ জন, হাসানুল হক ইনুসহ জাসদের ৩ জন, মাহি বি চৌধুরীসহ বিকল্পধারার ২ জন সংসদ সদস্য হন। এ ছাড়া বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও সংসদ সদস্য হন।

যদিও এবার জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের ময়মনসিংহ-৪ আসনে মহিবুর রহমানকে প্রার্থী মনোনীত করেছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া দলটি জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের লালমনিরহাট-৩ আসনে মতিয়ার রহমান, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে নাসিরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদের চট্টগ্রাম-৫ আসনে আবদুস সালাম, কাজী ফিরোজ রশীদের ঢাকা-৬ আসনে সাঈদ খোকনকে প্রার্থী মনোনীত করেছে।

জাতীয় পার্টিও এককভাবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিচ্ছে। আজ তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাপা গোপালগঞ্জের দুটি আসন বাদ রেখে ২৯৮ আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে।

১৪–দলীয় জোট আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোট। তাদের আসনেই তো প্রার্থী দিয়েছে, আমাদের সঙ্গে তো নির্বাচনী জোট নেই। এবার জোট হবে কি না, জানি না।
বিকল্পধারার মাহি বি চৌধুরী

জাপার কো–চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও ৩০০ আসনে প্রার্থী ঠিক করেছি। কাল (আজ সোমবার) পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের তালিকা প্রকাশ করবেন। এরপর দেখা যাক কী হয়।’

একইভাবে রাশেদ খান মেননের নির্বাচনী এলাকা ঢাকা-৮ আসনে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ফজলে হোসেন বাদশার রাজশাহী-২ আসনে মোহাম্মদ আলী, বিকল্পধারার মাহি বি চৌধুরীর মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে মহিউদ্দিন আহমেদ, আবদুল মান্নানের লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে ফরিদুন্নাহার, তরীকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর চট্টগ্রাম-২ আসনে খাদিজাতুল আনোয়ার ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পিরোজপুর-২ আসনে কানাই লাল বিশ্বাসকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

মাহি বি চৌধুরী গতকাল রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৪–দলীয় জোট আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোট। তাদের আসনেই তো প্রার্থী দিয়েছে, আমাদের সঙ্গে তো নির্বাচনী জোট নেই। এবার জোট হবে কি না, জানি না। এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি। যদি জোট হয় জোটে করব, আর যদি জোট না হয়, নিজের মতো করে নির্বাচন করব।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সমঝোতার মাধ্যমে গতবারের ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোর অধিকাংশই এবারও ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ বিষয়ে শিগগির দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। নতুন রাজনৈতিক দল ‘তৃণমূল বিএনপি’ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) নির্বাচনে প্রার্থী দিচ্ছে। দল দুটির নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া নেতারা। কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম সরকারের সহায়তায় বিএনপির নেতাদের দলে নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী করার চেষ্টা করছে বলে রাজনৈতিক মহলে জোর আলোচনা রয়েছে।

তৃণমূল বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা সমশের মবিন চৌধুরী সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) ও তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে নির্বাচন করতে চান। এ ছাড়া বিএনপি থেকে বিএনএমে যোগ দেওয়া সাবেক চার সংসদ সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ফরিদপুর-১ আসনে, মো. আবদুল ওহাব ঝিনাইদহ-১ আসনে, দেওয়ান শামসুল আবেদিন সুনামগঞ্জ-৪ আসনে ও আবদুর রহমান বরগুনা-২ আসনে নির্বাচন করবেন।

এ ছাড়া বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তিনি বর্তমান সংসদ সদস্য জাপার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের চট্টগ্রাম-৫ আসনে নির্বাচন করতে চান। এসব আসনের সব কটিতেই আওয়ামী লীগ গতকাল দলের মনোনীত প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

এর বাইরে বিএনপির ‘ধানের শীষ’ নিয়ে জয়ী হওয়া গণফোরামে দুই সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদের আসনেও প্রার্থী মনোনীত করেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি সংসদ থেকে পদত্যাগ করলেও এ দুজন শেষ পর্যন্ত সংসদে ছিলেন। এর মধ্যে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর সংসদে বিএনপির সমালোচনা করেন। যদিও আওয়ামী লীগ তাঁর নির্বাচনী এলাকা মৌলভীবাজার-২ আসনে শফিউল আলম চৌধুরী ও মোকাব্বির খানের সিলেট-২ আসনে শফিকুর রহমান চৌধুরীকে প্রার্থী মনোনীত করেছে।

আওয়ামী লীগের এই মনোনয়ন তালিকা কিছুটা অস্বস্তি তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন গত নির্বাচনে সমঝোতার মাধ্যমে জয়ী হওয়া একাধিক সংসদ সদস্য। তাঁদের মতে, আওয়ামী লীগ ১০০ আসন উন্মুক্ত রেখে তালিকা প্রকাশ করতে পারত। তাতে অন্য দলগুলোকে নির্বাচনমুখী করতে আরও আগ্রহী করা যেত। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ হয়তো অনেক প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু এই তালিকা নির্বাচনী মাঠে অনেক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।