মার্চের শুরুতে জি এম কাদের ও রওশন এরশাদপন্থীদের পৃথক কর্মসূচি ঘিরে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দলের নেতৃত্ব নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো আপস না হলে জাপায় আরেক দফা ভাঙন হতে পারে।
আগামী ২ মার্চ জাপার নীতিনির্ধারণী পর্ষদ প্রেসিডিয়ামের জরুরি সভা ডেকেছেন দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের। অন্যদিকে ৯ মার্চ জাপার নামে কেন্দ্রীয় সম্মেলন আহ্বান করেছেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ।
জি এম কাদের ও রওশন এরশাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২ মার্চের প্রেসিডিয়াম সভা ও ৯ মার্চের সম্মেলন ঘিরে দুই পক্ষই নিজেদের পাল্লা ভারী করার চেষ্টা করছে। সম্মেলন সামনে রেখে রওশন এরশাদ দলের সাবেক, নিষ্ক্রিয় এবং বাদ পড়া নেতাদের সংগঠিত করছেন। অন্যদিকে জি এম কাদের দলে নিজের অবস্থান আরও সংহত করতে কাউকে পদোন্নতি, আবার অব্যাহতি পাওয়া নেতাদের কাউকে কাউকে স্বপদে ফিরিয়ে আনছেন।
জাপার সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে দলের তিনজন নেতার অব্যাহতির আদেশ গত মঙ্গলবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানী, সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেকার আহসান হাসান ও যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক আজহারুল ইসলাম সরকার। একই দিন দলের দুই সংসদ সদস্য এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান (কুড়িগ্রাম-১ আসন) ও শরিফুল ইসলাম জিন্নাহকে (বগুড়া-২) প্রেসিডিয়ামের সদস্য করেন জি এম কাদের। এর আগে তাঁরা জাপার চেয়ারম্যানের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। এখন এই দুজনসহ জাপার প্রেসিডিয়ামে সদস্য হলেন ৩৭ জন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রেসিডিয়ামের সভা সামনে রেখে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ ছাড়া গতকাল বুধবার দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকে জাপার চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জাপার ৪১ সদস্যের প্রেসিডিয়ামে বর্তমানে আরও চারটি পদ শূন্য আছে। সম্প্রতি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দলের অন্যতম দুই কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও সৈয়দ আবু হোসেন, দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় ও শফিকুল ইসলামকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চারজনই ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘সমঝোতার’ মনোনয়ন থেকে বাদ পড়ায় শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধে জড়ান। অন্যদিকে ছেলে সাদ এরশাদকে রংপুরে মনোনয়ন না দেওয়ায় রওশন এরশাদ নির্বাচন থেকে বিরত থাকেন। এর রেশে নতুন করে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
নতুন করে জি এম কাদের ও রওশনপন্থীদের বিরোধের বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের ছয়জন নেতার সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা এ বিষয়ে তাঁদের পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, গত এক যুগের কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হয়েছে, কার্যত দুটি পক্ষই সুবিধাভোগী। এখন দুই পক্ষের শীর্ষ নেতৃত্বসহ অনুসারী নেতারা যত নীতিকথাই বলুন না কেন, মূলত নিজেদের স্বার্থেই দলের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে তাঁদের মধ্যে এই বিভক্তি। এখন রওশনকে ঘিরে দলে যে বিভক্তি, সেটিও মূলত জি এম কাদেরকে চাপে ফেলে সাদ এরশাদসহ সংশ্লিষ্টদের দলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
তবে জাপার নেতারা জানান, দুই পক্ষের নেতারা প্রায়ই অবস্থান পাল্টাচ্ছেন। একবার রওশনের দিকে যান তো কয় দিন পর জি এম কাদের পক্ষে ফিরছেন। নির্বাচনের পর দুজন কো-চেয়ারম্যানসহ ৯ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদের পক্ষ নেন। এর মধ্যে সাতজন প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম, লিয়াকত হোসেন, সালাহউদ্দিন মুক্তি, জহিরুল আলম, সাইফুদ্দিন আহমেদ, জহিরুল ইসলাম, ইমরান হোসেন মিয়া ইতিমধ্যে জি এম কাদেরের পক্ষে ফিরেছেন। ভাইস চেয়ারম্যান সরদার শাহজাহান ও গোলাম মোহাম্মদ রাজুও জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ফিরেছেন। তবে এখনো রওশনের সঙ্গে আছেন কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও সৈয়দ আবু হোসেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় ও শফিকুল ইসলাম। মূলত এই চার নেতা রওশনের পক্ষ নেওয়ার পর রওশনপন্থীদের পাল্লা ভারী হয়ে ওঠে।
জাপা দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে সমঝোতার মনোনয়ন না পাওয়া এবং আর্থিক অসহযোগিতার অভিযোগে শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধ প্রকাশ পাওয়ার পর ৩০ জনের মতো নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা রয়েছেন। এই নেতারাসহ দলের কেন্দ্রীয় থেকে জেলা পর্যায়ের অনেক পুরোনো, নিষ্ক্রিয় এবং বিভিন্ন সময়ে বাদ পড়া নেতাদের সংগঠিত করে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন রওশনপন্থীরা। এর পেছনে সরকারি মহলের প্রশ্রয় রয়েছে বলে জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে।
রওশনপন্থীদের নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ৯ মার্চ জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলন হবে। রওশন এরশাদ ইতিমধ্যে দুজনকে (চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক) দলের নেতৃত্ব থেকে বাদ দিয়েছেন। তাঁরা শুধু সংসদে নেতৃত্ব দেবেন, দল চালাবেন রওশন এরশাদ।
এর মধ্য দিয়ে জাপা আবার ভাঙনের দিকে যাচ্ছে কি না, জানতে চাইলে ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘যে হারে নেতাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, আমরা ধরে না রাখলে তারা অন্য দলে যাওয়ার চেষ্টা করবে। ৯ তারিখের সম্মেলনে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দল সারা দেশে বিস্তৃত হবে। এতে বিভক্তি হলে হবে। কথা হচ্ছে, আমরা লাঙ্গল পাব কি না। সেটা পাঁচ বছর পর দেখা যাবে।’
পাঁচবার ভাঙন
১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত জাপায় পাঁচবার ভাঙন হয়। সর্বশেষ দলের জ্যেষ্ঠ নেতা প্রয়াত কাজী জাফর আহমদ জাতীয় পার্টি নামে পৃথক দল করেন। এর মধ্যে কাজী জাফরের দলটি ছাড়া জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিসহ চারটি দল নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত। অন্য তিনটি হলো জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি।
জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘অনেকে বলছেন, দল ভাগ হয়ে যাবে। দল ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা এই মুহূর্তে আমি দেখি না। এরশাদ সাহেবের নাম দিয়ে, তাঁর আদর্শ নিয়ে আরও ১০টা দল হতে পারে। কিন্তু আমরা যে কাঠামোতে এগিয়ে যাচ্ছি, সেখান থেকে ভেঙে নিয়ে নতুন করে দল গঠন করার সেই পরিবেশ, পরিস্থিতি বা সম্ভাবনা আমি দেখছি না।’
সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, রওশন এরশাদপন্থীদের তৎপরতা মাথায় রেখে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা অনেকের সাংগঠনিক শাস্তি মওকুফ করে দলে ফেরাচ্ছেন। রওশনদের সম্মেলনের আগে ২ মার্চ জাপার প্রেসিডিয়ামের সভায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত আসতে পারে। যদিও এই মুহূর্তে জাপার সাংগঠনিক অবস্থা খুবই নাজুক। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দলটি ২৬৩ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৯০ শতাংশই জামানত হারায়। কেবল সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ২৬ আসনের ১১টিতে জয়ী হয়। এবারই প্রথম দলটি মাত্র ৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ ভোট পায়। এ অবস্থায় দলে ভাঙন অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে।