দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হাতছাড়া হয়ে গেছে নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদের। এর পর থেকেই নতুন স্থায়ী কার্যালয় কেনার চেষ্টা করছে তারা। জায়গা খোঁজার পাশাপাশি চাঁদাও তোলা হচ্ছে। এর মধ্যেই সোয়া তিন কোটি টাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় কেনার ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় এসেছে দলটি।
কেন্দ্রীয় কার্যালয় কেনা নিয়ে নিজের ফেসবুক পেজে ৯ আগস্ট একটি পোস্ট দিয়েছেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক (নুর)। তাতে বলা হয়, কার্যালয়ের বিষয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা মোটামুটি চূড়ান্ত। ১৮ হাজার ৯০০ টাকা প্রতি বর্গফুট মূল্যে ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকায় পল্টন এলাকায় কার্যালয় কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১ কোটি টাকা বুকিং মানি দেওয়া হবে। বাকিটাও দ্রুত পরিশোধ করা হবে।
ফেসবুকের এই পোস্টের সঙ্গে একটি বাণিজ্যিক ভবনে জায়গার দরদামসংক্রান্ত নথির ছবি যুক্ত করেন নুরুল হক। তাতে দেখা যায়, ১ হাজার ৬৫৫ বর্গফুটের একটি জায়গার দাম ধরা হয়েছে। প্রতি বর্গফুট শুরুতে ১৯ হাজার ৮০০ টাকা ধরা হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে ১৮ হাজার ৯০০ টাকা করা হয়। গাড়ি পার্কিংসহ যেটির মোট দাম পড়বে ৩ কোটি ২৩ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ টাকা। কার্যালয় কেনার বিষয়ে সহায়তা দিতে পোস্টে গণ অধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের তিনজন সদস্যের নাম ও মোবাইল নম্বর পোস্টে যুক্ত করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, কার্যালয়ের জন্য একটি জায়গা দেখা হয়েছিল। নেতা–কর্মীদের উৎসাহিত করতে এবং অর্থদাতাদের আগ্রহ বাড়াতে বিষয়টি ফেসবুকে দিয়েছিলাম। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক কোনো লেনদেন হয়নি। বিষয়টি গণমাধ্যমে ভিন্নভাবে আসায় প্রতিষ্ঠানটি এখন জায়গাটি গণ অধিকার পরিষদকে দিতে চাইছে না।
তবে নুরুল হক পল্টনের ওই বাণিজ্যিক জায়গাটি কিনেছেন বলে আলোচনা রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওই ভবনের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান জানায়, আলোচনার মাধ্যমে জায়গার দাম নির্ধারণ করে কীভাবে তা পরিশোধ করতে হবে, সেটি নুরুল হককে জানানো হয়েছে। তাঁর কাছে জায়গা বিক্রির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। বিক্রি বা অগ্রিম বাবদ কোনো টাকাও গ্রহণ করা হয়নি। বিষয়টি শুধু আলোচনার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ।
গণ অধিকার পরিষদের শীর্ষ দুই নেতা রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হকের দ্বন্দ্বের জেরে দলটি বিভক্ত হয় এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয় নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। পুরানা পল্টনের প্রিতম-জামান টাওয়ারে নুরুল হকের গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গত ২০ জুলাই ভবনমালিক তালা ঝুলিয়ে দেন।
ভবনমালিক কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান। তিনি গণ অধিকার পরিষদের ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। দলে ভাঙনের পর রেজা কিবরিয়া নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদে আগের দুটি পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
মালিকপক্ষ তালা দেওয়ার পর ২০ জুলাই বিকেলে তালা ভেঙে কার্যালয়ে প্রবেশ করেন নুরুল হকসহ নেতা-কর্মীরা। পরে তাঁদের পিটিয়ে বের করে দেয় পুলিশ। ঘটনার পর গণ অধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক, সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খানসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন ভবনমালিক মিয়া মশিউজ্জামান। মামলায় ভাড়া না দিয়ে ১৬ মাস ধরে কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার ও সেটি দখলে নিতে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
বর্তমানে গণ অধিকার পরিষদের কার্যালয়টি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে প্রতিদিন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা কার্যালয়ের নিচে যাচ্ছেন। যুগপৎ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি এই কার্যালয়ের সামনেই আয়োজন করছে নুরুলের নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদ।
কেন্দ্রীয় কার্যালয় কেনার বিষয়ে গত ২১ জুলাই ফেসবুকে প্রথম পোস্ট দেন নুরুল হক। তিনি সেখানে বলেন, দেড় থেকে দুই কোটি টাকায় পল্টন, মতিঝিল এলাকায় ভালো মাপের একটি কার্যালয় কেনা যাবে। এরপরই কার্যালয়ের জায়গা বা স্পেস কিনতে চাঁদা তুলতে শুরু করে দলটি। বিশেষ করে প্রবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাধ্যমে কার্যালয়ের জন্য এখন পর্যন্ত ৯০ লাখ টাকার অনুদান পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০ লাখ টাকা নগদ পাওয়া গেছে। আগামী মাসের মধ্যে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে বলে তারা আশাবাদী।
দলের উচ্চতর পরিষদের সদস্য শাকিল উজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কার্যালয় কেনার জন্য টাকা তোলার কার্যক্রম চলছে। যত দ্রুত পারা যায় কার্যালয় নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আপাতত মনোযোগ টাকা সংগ্রহের দিকে। কার্যালয়ের জায়গা চূড়ান্ত হলে মূল্যের বড় অংশ একসঙ্গে পরিশোধ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় কার্যালয় কেনার জন্য শুভাকাক্ষী ও দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে টাকা তোলা হলে, সেটি নিয়ে স্বচ্ছতার প্রশ্ন উঠতে পারে। এর আগে দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া নুরুল হকের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ বেশ কিছু অভিযোগ করেছিলেন। এ বিষয়ে দলের নেতারা বলছেন, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের জন্য দেওয়া টাকার হিসাব, অনুদানদাতার নামসহ জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।
গণ অধিকার পরিষদের দুটি অংশই দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়নি। ফলে দলের নামে কেন্দ্রীয় কার্যালয় নিতে পারছে না নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন অংশ। এ অংশের সভাপতির একক নামে কার্যালয় কেনা হবে বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে দলটির নেতারা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
দলের সভাপতি নুরুল হক বলেন, কার্যালয়ের জন্য পল্টন এলাকায় জায়গা খুঁজছি। কার্যালয় কেনাসংক্রান্ত একটি কমিটি হয়েছে। যেহেতু দলের নিবন্ধন হয়নি, তাই দলের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ–ছয়জনের নামে কার্যালয়টি নেওয়া হবে। এটি কারও ব্যক্তিগত নয়, দলীয় সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হবে, তা দলিল করে নেওয়া হবে।