৩৬ দিনের সময়সীমা: রাজপথে থেকে সরকারকে ‘পাহারা’ দেবে আওয়ামী লীগ

অক্টোবরজুড়ে ঢাকায় কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগ। বিএনপি যেন রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে, সেটিই বড় লক্ষ্য ক্ষমতাসীনদের।

আওয়ামী লীগের লোগো

আগামী ৩৫ দিন সরকারকে ‘পাহারা’ দেবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিএনপি অক্টোবরে সরকার পতনের দাবিতে ঢাকা অচল করে দিতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে এ পরিকল্পনা ক্ষমতাসীন দলটির। অক্টোবর মাসজুড়ে প্রায় প্রতিদিন সভা–সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থেকে সরকারকে ‘পাহারা’ দিতে চান আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, নভেম্বরের শুরুতেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর আগের সময়টা খুবই স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচনা করছে ক্ষমতাসীনেরা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণা দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও সরকার কিছুটা হলেও চাপে পড়েছে। এ সুযোগে বিরোধী দল বিএনপি এক দফার দাবিতে ‘মরণকামড়’ দিতে চাইছে। এ ছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর কিছু হলে দলের নেতা-কর্মীরা রাজপথে নেমে আসতে পারেন, এমন আশঙ্কাও আছে। ফলে সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজপথ দখলে রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আগামী ১ নভেম্বর থেকে নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। কারণ, সংবিধান অনুসারে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। এ সময়ে যে সরকার থাকবে, তা নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে পরিচিত।

বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে ষড়যন্ত্র করছে। আওয়ামী লীগ রাজপথে থেকে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করবে।
শাজাহান খান, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ

তবে ভোটের তফসিল কবে ঘোষণা করতে হবে, এ বিষয়ে আইনে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে, ইসি থেকে এমন অভাসই পেয়েছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, অক্টোবর মাসজুড়ে বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি থাকবে আওয়ামী লীগের। এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। আরেকটি বিষয় হচ্ছে বিএনপি যে ধরনের কর্মসূচি দেবে, আওয়ামী লীগও একই রকম কর্মসূচি নেবে। বিএনপির কর্মসূচি না থাকলেও সহযোগী সংগঠনকে দিয়ে ফাঁকা দিনগুলোয়ও আওয়ামী লীগ কোনো না কোনো কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকবে।

আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি বলেছে সরকারের পতন ঘটাবে। আমরা সরকারকে পাহারা দেব। তফসিল ঘোষণার আগপর্যন্ত প্রতিদিন রাজপথে থাকব। বিএনপিকে রাজপথে পরাজিত করেই আমরা আগামী নির্বাচনে বিজয় অর্জন করব।’

ভিসা নীতির ফাঁদে বিএনপিকে ফেলতে চায় আ.লীগ

মার্কিন ভিসা নীতির প্রয়োগের বিষয়কে দলীয় কর্মীদের চাঙা করার কাজে ব্যবহার করতে চাইছে বিএনপি। আওয়ামী লীগও ভিসা নীতির ফাঁদে ফেলতে চাইছে বিএনপিকে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে দেশে নির্বাচনী আবহ তৈরি হবে। নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়বে রাজনৈতিক দলগুলো। তখন নির্বাচনের পরিবেশ রক্ষায় কঠোর ভূমিকায় থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনের পরিবেশ রক্ষা করা নির্বাচন কমিশনেরও সাংবিধানিক দায়িত্ব। নির্বাচনের সময়ে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা সহিংস আন্দোলন, ঢাকা অচল কিংবা ঘেরাও জাতীয় কর্মসূচি দিলে তা নির্বাচন প্রতিহতের শামিল হবে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন ভিসা নীতির আওতায় পড়ে যাবেন বিএনপির নেতারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও চড়াও হওয়ার সুযোগ পাবে।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, যে ভিসা নীতি আওয়ামী লীগের ওপর খড়্গ হিসেবে দেখাচ্ছে বিএনপি। সেই ভিসা নীতি বিএনপির জন্যও ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করতে চায় আওয়ামী লীগ। এ জন্য নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কিছুটা আগে হতে পারে। নির্বাচনের সময়ে বিএনপির বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ তুলে তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নীতি প্রয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ তৈরি করবে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, নির্বাচনের সময়ে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি মোকাবিলার মূল কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপরও আওয়ামী লীগ প্রয়োজন মনে করলে রাজপথে থাকবে।

বিএনপি এর মধ্যে আগামী ৪ অক্টোবর পর্যন্ত সভা-সমাবেশসহ ১২ দিনের কর্মসূচি পালন করছে। আওয়ামী লীগও ৪ অক্টোবর পর্যন্ত সাত দিনের কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে আছে। এর মধ্যে দুই দলের কর্মসূচির কোনো কোনোটি একই দিনে, কাছাকাছি স্থানে।

নির্বাচনী প্রস্তুতির চেয়ে আন্দোলন ঠেকানোই গুরুত্বপূর্ণ

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা এখন অনেকটাই নিশ্চিত যে বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে তা ঠেকাতে চাইবে। এর আগে সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করার চেষ্টা করবে। এ পরিস্থিতিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের লড়াইয়ের চেয়ে আন্দোলনের মাঠে লড়াই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

দলটির নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, বিএনপি প্রথমে অক্টোবরে রাজধানী ঢাকা অচল করে সরকার পতনের চেষ্টা চালাবে। তবে তারা এ কাজে সফল হবে না। কারণ, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো এর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এমনকি অঘোষিতভাবে বিএনপি হঠাৎ করে রাস্তায় নেমে যেতে পারে, এমনটাও বিবেচনায় রেখেছে ক্ষমতাসীন দল। সে ধরনের পরিস্থিতিতে স্বল্প সময়ের নোটিশে রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে দলের নেতা–কর্মীদের।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি ঠেকানো ও ভোটের প্রস্তুতি একসঙ্গে চালাবে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে ষড়যন্ত্র করছে। আওয়ামী লীগ রাজপথে থেকে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করবে।

টানা কর্মসূচি আসছে

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, অক্টোবরে ঢাকার কর্মসূচিগুলো কী ধরনের হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি। তবে সভা-সমাবেশের কর্মসূচি বেশি থাকবে। যা কিছুই করা হোক না কেন চোখ থাকবে বিএনপির দিকে। তাঁরা যে ধরনের কর্মসূচি দেবে, তা প্রতিহত করার মতো কর্মসূচি আওয়ামী লীগের থাকবে।

আওয়ামী লীগের মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার দুজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি যদি খালি হাতে সমাবেশ করে, আওয়ামী লীগও খালি হাতে সমাবেশ করবে। বিএনপি ঘেরাও কিংবা অবরোধ জাতীয় কর্মসূচি দিলে তা আক্রমণাত্মক হতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটাসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েই নামবে।

বিএনপি এর মধ্যে আগামী ৪ অক্টোবর পর্যন্ত সভা-সমাবেশসহ ১২ দিনের কর্মসূচি পালন করছে। আওয়ামী লীগও ৪ অক্টোবর পর্যন্ত সাত দিনের কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে আছে। এর মধ্যে দুই দলের কর্মসূচির কোনো কোনোটি একই দিনে, কাছাকাছি স্থানে। ঘোষিত কর্মসূচির বাইরেও বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সভা-সমাবেশ করছে। এর মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গত রোববার নয়াপল্টনে সমাবেশ করে বিএনপি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গতকাল মঙ্গলবার কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় ‘শান্তি ও উন্নয়ন’ সমাবেশ করেছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা, পরিবহন শ্রমিক, সংস্কৃতিসেবীসহ পেশাজীবীদেরও নামানোর প্রয়োজন হতে পারে। এ বিষয়েও দলের প্রস্তুতি রয়েছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অক্টোবরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কোনো বিশ্রাম থাকবে না। তিনি বলেন, এমনিতে রাজধানীর প্রতিটি আসন ধরে ধরে সমাবেশের পরিকল্পনা আছে। এর বাইরে প্রয়োজন হলে মিছিল ও অন্যান্য কর্মসূচি থাকবে।

নির্ধারিত কর্মসূচির বাইরে অক্টোবরে ঢাকায় দুটি মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন উপলক্ষে বড় সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। ৭ অক্টোবর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিন উত্তরার দিয়াবাড়িতে সুধী সমাবেশ হবে। এই সুধী সমাবেশে উত্তরা ও মিরপুর এলাকার সংসদ সদস্যদের প্রত্যেককে এক থেকে দুই লাখ করে লোক আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০ অক্টোবর মেট্রোরেলের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ চালু করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ওই দিনও সুধী সমাবেশ হবে। তবে স্থান এখনো ঠিক হয়নি। এই সুধী সমাবেশেও বিপুল জমায়েত নিশ্চিত করা হবে। এর আগে ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা দ্রুতগতির উড়ালসড়কের উদ্বোধন উপলক্ষে আগারগাঁওয়ের পুরোনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা মাঠে সুধী সমাবেশ হয়। ওই সমাবেশ বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকা প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল।