আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলটি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপি সভাপতিসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারতকে পাশে পাবে আওয়ামী লীগ—এমন একটা ধারণা নিয়ে দেশে ফিরেছেন ক্ষমতাসীন দলটির প্রতিনিধিরা। তিন দিনের ভারত সফরে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলটি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি জেপি নাড্ডাসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে।
বিজেপির আমন্ত্রণে ৬ থেকে ৯ আগস্ট ভারত সফর করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। গতকাল বৃহস্পতিবার এই সফর নিয়ে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সফরে তাঁরা জেনেছেন যে ভারত বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায়।
ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক রক্তের অক্ষরে লেখা। এই সম্পর্কের সাথে কারও সম্পর্ক তুলনীয় নয়।আব্দুর রাজ্জাক
এই দলের সদস্যদের সূত্রে জানা গেছে, ভারতের ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মার্কিন ভিসা নীতি, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ভারতের নেতারা জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের মতো করে এ বিষয়ে কাজ করছেন। ক্রমে এর প্রভাব দেখা যাবে।
প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের প্রচেষ্টার প্রভাব ইতিমধ্যে কিছুটা দৃশ্যমান হওয়ার কথা বলেন দেশটির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা। এ ছাড়া বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব যেকোনো রাজনীতিকের চেয়ে শক্তিশালী—এই বিশ্বাসের কথাও বলেছেন ভারতের নেতারা।
প্রতিনিধিদলের সূত্র আরও জানায়, বিজেপির সভাপতি জেপি নাড্ডাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সখ্য বৃদ্ধির বিষয়টি এসেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি অর্থনৈতিক, যেমনটা ভারতের সঙ্গেও চীনের রয়েছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল তাদের বলেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় জামায়াতে ইসলামী, বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে পাকিস্তানের প্রভাব আবার বেড়ে যাবে, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ভারতের মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারাও তা স্বীকার করেছেন বলে আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন।
আমরা ভারত গিয়েছি আমন্ত্রণ জানানোর প্রেক্ষিতে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিসে যাওয়ার জন্য ইচ্ছা পোষণ করেছেন। আর বিএনপি নিজে থেকে বিভিন্ন জায়গায় যায়।হাছান মাহমুদ
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের ভূমিকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, নির্বাচন করবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, সহযোগিতা করবে বাংলাদেশ সরকার। এখানে ভারতের কিছু করার নেই। এ বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করেনি। তা ছাড়া ভারতের সাথে বাংলাদেশের ‘কানেক্টিভিটি’ অনেক বেশি। বাংলাদেশে কী হচ্ছে, তারা সবকিছু জানে।
আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, ‘ভারতের জন্য চীন সব সময় দুশ্চিন্তার কারণ। সে জন্যই তাদের সীমান্তে মাঝে মাঝে উত্তেজনা তৈরি হয়। আমরা বলেছি আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়। সেই নীতি নিয়েই আমরা চলি। কিন্তু ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক রক্তের অক্ষরে লেখা। এই সম্পর্কের সাথে কারও সম্পর্ক তুলনীয় নয়।’
আগামী নির্বাচনে জামায়াতের বিষয়ে ভারতের মনোভাব সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমাদের সাথে আলোচনা হয়নি। দুই দেশেরই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে যোগাযোগ আছে, তথ্য আদান–প্রদান করা হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলটি ৬ আগস্ট রাতে ভারতের দিল্লি পৌঁছায়। পরদিন প্রথমে বিজেপির সভাপতি জেপি নাড্ডার বাসায় বৈঠক হয়। এ সময় নাড্ডা বলেন, তাঁর দল এ অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাস দমনের স্বার্থে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।
সংবাদ সম্মেলনে ভারত সফর করা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমরা যাদের সাথে আলোচনা করেছি, তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, বাংলাদেশে সংবিধানের আলোকে নির্বাচন হবে। এখানে যেসব দাবি আছে সেগুলোর প্রয়োজন নাই, এটা তারা বোঝে। তারা মনে করে সংবিধানের আলোকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট বাংলাদেশে হবে। আমাদের সাথে জঙ্গিবাদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জঙ্গিদের একটি ক্রস বর্ডার কানেকশন রয়েছে, এটা নিয়ে তারা ওয়াকিবহাল আছে।’
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিএনপি বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে এখন দেখছে যে কিছু নেই। পানিতে ডুবে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ রাজনীতি কার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।
এ সময় তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপির বিদেশপ্রীতি আছে। তাদের ধরনা দেওয়া কমেনি। তবে তা করে কোনো লাভ হচ্ছে না, সেটা অনুধাবন করতে পেরেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ভারত গিয়েছি আমন্ত্রণ জানানোর প্রেক্ষিতে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিসে যাওয়ার জন্য ইচ্ছা পোষণ করেছেন। আর বিএনপি নিজে থেকে বিভিন্ন জায়গায় যায়।’
আব্দুর রাজ্জাক সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বলেন, ‘ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ। মুক্তিযুদ্ধে তারা অর্থ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরে ভারতের সাথে সম্পর্ক অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়েছে। আর বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক অনেক উঁচুতে।’ তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে অভাবনীয়ভাবে। অতীতে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে ১০ ট্রাক অস্ত্র ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এখন বাংলাদেশ এক ইঞ্চি মাটিও কাউকে প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেবে না। শেখ হাসিনার এমন পদক্ষেপে বিজেপি সন্তুষ্ট।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলটি ৬ আগস্ট রাতে ভারতের দিল্লি পৌঁছায়। পরদিন প্রথমে বিজেপির সভাপতি জেপি নাড্ডার বাসায় বৈঠক হয়। এ সময় নাড্ডা বলেন, তাঁর দল এ অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাস দমনের স্বার্থে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।
ওই দিন দুপুরে বিজেপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক বিনোদ তড়ের সঙ্গে বৈঠক হয়। বিকেলে ভারতের পার্লামেন্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে তাঁর দপ্তরে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়। এ সময় জয়শঙ্কর বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে দুই দেশের মধুর সম্পর্ক যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি উচ্চতায়।
৮ আগস্ট ভারতের রাজ্যসভার নেতা ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের সঙ্গে বৈঠক হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এ সময় ভারতের মন্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলকে আশ্বস্ত করেন যে খাদ্যশস্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়টি ভারত সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে। একই সঙ্গে ভারত যাতে বাংলাদেশ থেকে আরও পণ্য আমদানি করতে পারে, সে জন্য তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে সক্রিয় সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। এ সময় বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকা দেওয়ারও অনুরোধ করেন।
জি-২০ ফোরামের ভারতের কো-অর্ডিনেটর ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে বৈঠক হয়। এ সময় আগামী ৯-১০ সেপ্টেম্বর ভারতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণের বিষয়টি উল্লেখ করেন।
এর বাইরে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলটি বিজেপির মহিলা মোর্চা, যুব মোর্চা এবং ভারতীয় গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে।
সংবাদ সম্মেলনে আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ভারত সফর করা সংসদ সদস্য আরমা দত্ত ও মেরিনা জাহান এবং সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী উপস্থিত ছিলেন।