আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করেন, রাস্তায় বসে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি দিয়ে ঢাকা ‘অচল’ করার মতো পদক্ষেপ নিতে পারে বিএনপি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় সমাবেশ করার চার দিন পরই রাজধানী ঢাকায় বিএনপির আরেকটি মহাসমাবেশের উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে আলোচনা চলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে।
দলটির নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ মনে করে, সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়ানো এবং বিদেশিদের কাছে জনসমর্থন দেখানো বিএনপির এই মহাসমাবেশের (বৃহস্পতিবার) লক্ষ্য হতে পারে। আবার কারও কারও মত হচ্ছে, বিএনপি সুযোগ পেলে সরকার পতনের দাবিতে রাস্তা অবরোধ বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘেরাওয়ের চেষ্টা করতে পারে। ঢাকা ‘অচল’ করার মতো পদক্ষেপও নিতে পারে। তাই ‘ঝুঁকি’ এড়াতে আওয়ামী লীগও পাল্টা সমাবেশের কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আওয়ামী লীগ ভোট পর্যন্ত রাজপথে সক্রিয় থাকবে, এটা আগেই ঘোষণা করা হয়েছে। আর বিএনপির কর্মসূচি মানেই মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সতর্ক থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী একাধিক সূত্র বলছে, মাত্র ছয় দিনের মধ্যে ঢাকায় দুটি বড় সমাবেশ করার যে সিদ্ধান্ত বিএনপি নিয়েছে, এর পেছনে দেশি-বিদেশি প্রভাবশালী কোনো পক্ষের সায় থাকতে পারে। এই পরিস্থিতি গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও নীতিনির্ধরণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনের কোনো এক পর্যায়ে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো রাস্তায় বসে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি দিয়ে রাজধানী অচল করে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। আগামী বৃহস্পতিবার সে রকম কিছু ঘটবে—এমনটা ঠিক মনে করেন না তাঁরা। তবে বিএনপি কী করে, তা দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার ঝুঁকিও নিতে চান না তাঁরা। মূলত সেই চিন্তা থেকেই পাল্টা সমাবেশের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। একই চিন্তা থেকে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে আছে আওয়ামী লীগ, যাতে কোনো কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি ঢাকা ‘অচল’ করার সুযোগ নিতে না পারে।
সরকার ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলছে, রাজপথের কর্মসূচি হয়তো আর বেশি দিন শান্তিপূর্ণ থাকবে না। এর কারণ, বিএনপি নির্বাচন বর্জন এবং তা ঠেকানোর পথে এগোচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আগের চেয়ে বেশি তৎপর করার দরকার হতে পারে। বিএনপির চাওয়া মেনে সমাবেশের স্থানের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা বিচার-বিশ্লেষণ করা হবে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের পাশাপাশি সরকারের ভেতর থেকেও সতর্কতার মাত্রা বাড়ানো লাগবে। তা আগামী বৃহস্পতিবারই শুরু হতে পারে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন, বিএনপি এখন ঢাকায় বড় জমায়েত করতে পারছে। ফলে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাঙা ভাব দেখা যাচ্ছে। তবে এখনো তারা সাধারণ মানুষকে টানতে পারেনি। তাই ঘন ঘন বড় সমাবেশের ডাক দিয়ে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে চাইছে।
গত শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ করে বিএনপি। সেই সমাবেশ থেকে বৃহস্পতিবার মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই দিন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের সমাবেশ ছিল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে। ওই সমাবেশ থেকে ‘তারুণ্যের জয়যাত্রা’ নামে সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল সোমবার (গতকাল)। পরে রাতে জানানো হয়, সমাবেশ হবে বৃহস্পতিবার।
বিএনপি এখন মনে করছে তাদের অনেক শক্তি, সরকার বুঝি পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখন দেখবে কিছুই হচ্ছে না, তখন নির্বাচনে অংশ না নেওয়া ছাড়া তাদের উপায় থাকবে না।কাজী জাফর উল্যাহ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ
শনিবার যুবলীগের সমাবেশের দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নোয়াখালীতে ছিলেন। দলীয় সূত্র জানায়, সন্ধ্যার পর ওবায়দুল কাদের সোমবারের সমাবেশ পিছিয়ে বৃহস্পতিবার করার নির্দেশ দেন। শুধু যুবলীগ নয়, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগকে নিয়ে যৌথভাবে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত হয়। তাদের সমাবেশ হবে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে। এতে ঢাকার দুই মহানগর ছাড়াও গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা জেলা এবং ময়মনসিংহ জেলার তিন সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও অংশ নেবেন।
‘তারুণ্যের জয়যাত্রা’ সমাবেশ নিয়ে গতকাল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তিন সহযোগী সংগঠন যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে। এ বিষয়ে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবার ঢাকায় তরুণদের ঢল নামাবে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ।
কেউ যাতে সহিংসতা করতে না পারে, সে জন্য সতর্কতার অংশ হিসেবে বিএনপির মহাসমাবেশের দিন ‘তারুণ্যের জয়যাত্রা’ সমাবেশ করা হবে বলে জানান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক।
বিএনপির বৃহস্পতিবারের মহাসমাবেশের আগে আজ মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সব সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করবেন। সেখান থেকে নতুন আরও দিকনির্দেশনা আসতে পারে।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, আওয়ামী লীগ কোনো ঝুঁকি নেবে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে হলে নমনীয়তা দেখানোর সুযোগ নেই। আর সতর্কতার অংশ হিসেবে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে বৃহস্পতিকার ‘শান্তি ও উন্নয়ন’ সমাবেশ হবে।
আবার কেন্দ্রীয় কমিটির কারও কারও ভাবনা হচ্ছে, বিএনপি আক্রমণাত্মক হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তারা চাইছে পুলিশ তাদের বাধা দিক। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিয়তই চোখ রাখছে। আওয়ামী লীগকে আগ্রাসী শক্তি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিপীড়কের ভূমিকায় দেখাতে চাইছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কোনো কোনো নেতা মনে করেন, শোকের মাস আগস্টে কর্মসূচি করে সাড়া ফেলতে পারবে না—এমন ভাবনা থেকে হয়তো বিএনপি জুলাইয়ের শেষ দিকে পরপর বড় সমাবেশ করে সরকারকে চাপে রাখতে চাইছে। এর মাধ্যমে বিদেশিদের দেখাতে চাইছে, তারা রাজপথে শক্তি অর্জন করেছে।
আবার কেন্দ্রীয় কমিটির কারও কারও ভাবনা হচ্ছে, বিএনপি আক্রমণাত্মক হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তারা চাইছে পুলিশ তাদের বাধা দিক। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিয়তই চোখ রাখছে। আওয়ামী লীগকে আগ্রাসী শক্তি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিপীড়কের ভূমিকায় দেখাতে চাইছে বিএনপি।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ ভোট পর্যন্ত রাজপথে সক্রিয় থাকবে, এটা আগেই ঘোষণা করা হয়েছে। আর বিএনপির কর্মসূচি মানেই মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সতর্ক থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তিনি মনে করেন, বিএনপি একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ চাইছে। মূলত নির্বাচন বানচাল ও বিদেশিদের দেখানোর জন্য তারা মরিয়া। আওয়ামী লীগ তা হতে দেবে না।
আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন আলোচনাও আছে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা কার্যত নেই। বিএনপিকে আলোচনায় ডেকে আওয়ামী লীগ দুর্বলতা দেখাতে রাজি নয়। এ অবস্থায় বিএনপি রাজপথেই সংকটের সমাধান চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই বিএনপির ‘সর্বোচ্চ শক্তি’ দেখানোর সময়টি কখন আসছে, তা সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন, বিএনপি এখন ঢাকায় বড় জমায়েত করতে পারছে। ফলে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাঙা ভাব দেখা যাচ্ছে। তবে এখনো তারা সাধারণ মানুষকে টানতে পারেনি। তাই ঘন ঘন বড় সমাবেশের ডাক দিয়ে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে চাইছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে সক্রিয় থাকায় সাধারণ মানুষকে বিএনপি টানতে পারছে না। কারণ, মানুষ মনে করে, সরকারের পতন ঘটানোর ক্ষমতা বিএনপির নেই। তারা সাধারণ মানুষের এই ধারণা ভাঙতে চাইছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, রাজধানীর রাজপথ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকলে ভোট ঠেকাতে পারবে না বিএনপি। গত ১৬ বছরে তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। তাই বিএনপি এবার ঢাকার ‘দুর্গ’ ভাঙার চেষ্টা করবে। এ জন্য বিএনপি সারা দেশে নানা কর্মসূচি পালন শেষে এখন রাজধানী ঢাকায় মনোযোগ দিতে চাইছে।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, বৃহস্পতিবার বিএনপিকে নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। মহাসমাবেশে বেশি মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকাবাসী দুর্ভোগে পড়বে—এ যুক্তিতে অন্য কোনো স্থানে মহাসমাবেশ করতে দলটিকে বলা হতে পারে। এর আগে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের স্থান নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়। বিএনপি চেয়েছিল নয়াপল্টনে। পুলিশ অনুমতি দেয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে সমাবেশ করেনি দলটি। শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করতে হয়। অন্যদিকে ১০ ডিসেম্বরের দুই দিন আগে পুলিশ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করে।
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, রাজপথ দখল ও ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ মার্কিন ভিসা নীতি বা নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করবে না। প্রয়োজন হলে বিএনপির ওপর শক্তি প্রয়োগ করা হবে। বিএনপি আক্রমণাত্মক হলে তাদের ওপর চড়াও হওয়ার যৌক্তিক সুযোগ তৈরি হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি এখন মনে করছে তাদের অনেক শক্তি, সরকার বুঝি পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখন দেখবে কিছুই হচ্ছে না, তখন নির্বাচনে অংশ না নেওয়া ছাড়া তাদের উপায় থাকবে না। আর আওয়ামী লীগ যেহেতু সরকারে আছে, তাই সতর্ক অবস্থানে থাকা দায়িত্ব। সেটাই করছে আওয়ামী লীগ।