বিকেল চারটার দিকে উত্তরার উত্তর-পশ্চিম এলাকা ১১ নম্বর সেক্টর ঘিরে যখন পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলছিল, ওই সময় আজমপুরে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের মোড়ে একটি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ান শিক্ষার্থী জোবায়দা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘মিথ্যা মামলায় বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি চাই’। এর নিচে ইংরেজিতে লেখা, ‘ফ্রি আসিফ মাহতাব, ফ্রি স্টুডেন্টস অ্যান্ড আদার্স’। এই তিনজন শিক্ষার্থীর পেছনে ও আশপাশে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও পুলিশের বেশ কিছু সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ানোর কয়েক মিনিটের মাথায় বেশ কয়েকজন নারী এসে জোবায়দাকে রাস্তা থেকে চলে যেতে বলেন। তাঁরা জোবায়দাকে নানা প্রশ্ন করেন, তাঁর কে মারা গেছেন, কে বন্দী হয়েছেন, জোবায়দা কোথায় পড়েন, তাঁর বাসা কোথায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। জোবায়দা উত্তর দেন, ‘আমার অনেক ভাই মারা গেছে, আমার ভাইদের বন্দী করা হয়েছে।’
একপর্যায়ে জোবায়দা বলেন, ‘আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন কেন, গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন? আমি রাস্তায় দাঁড়িয়েছি, এটা আমার অধিকার।’
একপর্যায়ে বোরকা পরা জোবায়দাকে মুখের নেকাব খুলতে বলা হয়। তখন জোবায়দা পাল্টা জবাব দেন, ‘কেন খুলব? আমি পর্দা করি।’ এরপর প্রশ্ন, তুমি কি সব সময় বোরকা পরো? জোবায়দা বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, সব সময়।’
পরে চাপাচাপিতে জোবায়দাসহ তিনজন রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের দিকে চলে যান। সেখানে আরও অনেক শিক্ষার্থীকে অপেক্ষমাণ থাকতে দেখা যায়। জোবায়দা নিজেকে টঙ্গী এলাকার একটি কলেজের শিক্ষার্থী পরিচয় দেন।
অপর দিকে ওই নারীদের একজন নিজেকে ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয় দিয়ে জানান, তাঁর নাম রুমা আজাদ। আরেকজন সাদিয়া ইসলাম জানান, তিনি উত্তরা ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক।
রুমা আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই। রাস্তায় এগুলো দেখতে চাই না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণমিছিল কর্মসূচির অংশ হিসেবে শুক্রবার জুমার নামাজের পর উত্তরার তিনটি জায়গা থেকে কর্মসূচি শুরু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন ওই এলাকার আন্দোলনকারীরা।
এলাকাগুলো হলো উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদ, ৭ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদ ও আজমপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। ঘুরে দেখা যায়, তিনটি জায়গাতেই সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য অবস্থান নেন। আজমপুর জামে মসজিদ এলাকা থেকে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি ঘিরে সকাল থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জসীমউদ্দীন, আজমপুর, বিএনএস সেন্টার, হাউস বিল্ডিং এলাকায় অবস্থান নেন। জুমার নামাজের পর লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র হাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে বিএনএস সেন্টারের নিচে দাঁড়ান। সেখানে আগে থেকেই এপিবিএন ও পুলিশ সদস্যরা ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১১ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদ ঘিরে জমজম টাওয়ারের মোড়ে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অবস্থান এলাকায় উত্তেজনার সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে বিকেল চারটার দিকে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের মাইলস্টোন কলেজের প্রধান শাখার সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ছয়জন শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে আহত হন। এর মধ্যে উত্তরা লেক ভিউ হাসপাতালে তিনজন, শিনশিন জাপান হাসপাতালে একজন এবং উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়। তাঁরা পুলিশের রাবার বুলেটে আহত হন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে।
বিকেল সোয়া চারটার দিকে শিক্ষার্থী তানভীর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জুমার নামাজের পর শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করতে আসি। এ সময় জমজম টাওয়ারের দিক থেকে লোহার রড, লাঠি, রামদা ও অস্ত্রসহ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একটি মিছিল আসে। এসেই তারা আমাদের লাঠিপেটা শুরু করে। মেয়েদের হেনস্তা করে। একজন ছাত্রীকে গলা টিপে ধরে উত্তরা পশ্চিম থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক জুয়েল। আমার বন্ধু জোবায়ের সিয়াম এর প্রতিবাদ করলে জুয়েল হুমকি দেয়, বেশি কথা বললে গুলি করে দেব।’
অবশ্য আবদুর রাজ্জাক জুয়েল রাত পৌনে নয়টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজকে তো আমাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না। তা ছাড়া আমি এলাকায় ছিলাম না।’
জমজম টাওয়ারের সামনে আওয়ামী লীগের জমায়েত সম্পর্কে জানতে চাইলে জুয়েল বলেন, ‘এটা কারা করেছে আমি জানি না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১১ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডের একজন বাসিন্দা জানান, পুলিশের ধাওয়ার মুখে শিক্ষার্থীরা দৌড়ে বিভিন্ন গলির বাসাবাড়িতে আশ্রয় নেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের বের করে এনে ব্যাপক মারধর করেন।