এক ‘অবিশ্বাস্য’ কাণ্ডই ঘটালেন মো. শাহ জাহান মিয়া। রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরের এই ব্যক্তি সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়েছেন। সাইকেলে ঘুরে ঘুরে তিনি দোকানে দোকানে ওষুধ, মোমবাতি, ব্লেড, মশার কয়েল ইত্যাদি বিক্রি করেন। থাকেন ভাড়া বাসায়। মেয়র পদে দাঁড়িয়ে তাঁর এত ভোট পাওয়া অনেকের কাছেই যেন অবিশ্বাস্য।
সিলেটের রাজনৈতিক মহলে শাহ জাহান মিয়ার ভোট নিয়ে এখন চলছে নানা বিশ্লেষণ। অনেকের মনে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহও তৈরি করেছে। বিশেষ করে, কিছু কেন্দ্র ছাড়া বেশির ভাগেই ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পরও এত ভোট কী করে হয়, তা নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন আছে।
এই নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির (লাঙ্গল) নজরুল ইসলাম। তিনি শাহ জাহান মিয়ার চেয়ে মাত্র ২০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন। আর নির্বাচন না করেও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মাহমুদুল হাসান (হাতপাখা) পেয়েছেন ১২ হাজার ৭৯৪ ভোট।
ঘোষিত ফলাফলে জাতীয় পার্টির প্রার্থী দ্বিতীয়, শাহ জাহান মিয়া তৃতীয় এবং ইসলামী আন্দোলনের মাহমুদুল হাসান চতুর্থ হয়েছেন। এই তিন প্রার্থী পেয়েছেন ৯৩ হাজার ৩৪৪ ভোট।
ইসলামী আন্দোলনের মাহমুদুল হাসান মনে করেন, এই ফলাফল ‘সাজানো’। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিলেটে স্মরণকালের সবনিম্ন উপস্থিতির ভোট হয়েছে। আমি মনে করি, একটা সাজানো নির্বাচন হয়েছে এবং সে অনুযায়ী ফলাফল উপস্থাপন করা হয়েছে। এই যে ৩০ হাজার ভোট (শাহ জাহানের), মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য এটা দেখানো হয়েছে।’ যদিও নির্বাচন কমিশন বলেছে, এই নির্বাচনে ৪৬ দশমিক ৭১ শতাংশ ভোট পড়েছে।
মাহমুদুল হাসানের দল ইসলামী আন্দোলন এই নির্বাচন বর্জন করেছে। ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এর পরপরই দলটি সব নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। এর ১০ দিনের মাথায় গতকাল বুধবার সিলেটের নির্বাচন হলো। তাতে মাহমুদুল হাসান প্রায় ১৩ হাজার ভোট পেয়েছেন। তবে মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেছেন, এই ভোট ‘দেখানো’ হয়েছে।
কার্যত বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় শুরুতেই আওয়ামী লীগের জন্য ভোট সহজ হয়ে যায়। এরপর ইসলামী আন্দোলনও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। ফলে অনেকটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হয়ে উঠে এই নির্বাচন। নির্বাচনে আগাগোড়া একমাত্র মাঠে থাকেন জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম। সরকারবিরোধী ভোটের নানা হিসাব-নিকাশে শেষ দিকে তিনি আলোচনায় আসেন। ফলাফলে দেখা গেল, তিনি ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট পেয়েছেন। বিজয়ী মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯১ ভোট পেয়েছেন। যা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সাত প্রার্থীর মোটে ভোটের চেয়ে ১৩ হাজার ৩৩৯ বেশি। এর মধ্যে সবাইকে চমকে শাহ জাহান মিয়া পেয়েছেন ২৯ হাজার ৬৮৮ ভোট।
যদিও শাহ জাহান মিয়ার দাবি, তিনি আরও বেশি ভোট পেতেন। তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকার অভাবে পোস্টার ছাপাতে পারিনি, সাইকেলে প্রচার চালাইছি। নইলে এক লাখ ভোট পাইতাম।’
অবশ্য সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ মনে করেন, নির্বাচনে সরকারি দলের শক্ত বিরোধী পক্ষ ছিল না। জাতীয় পার্টির নজরুল যে ভোট পেয়েছেন, সেখানে ওই শাহ জাহান মিয়াকে প্রার্থী করলেও হয়তো এই ভোটই পেতেন।
তবে এবারের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে উল্লেখ করে ফারুক মাহমুদ বলেন, কিছু কেন্দ্রে লোকজন গেছেন। আসলে এবার যে কী মেকানিজম হয়েছে, সেটা কেউ জানে না।
সিলেটের সমাজসেবী, রাজনৈতিক কর্মী কেউই মনে করেন না, শাহ জাহান মিয়া এত ভোট পেতে পারেন। একইভাবে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থান বিবেচনায় নজরুল ইসলামেরও এত ভোট পাওয়ার কথা নয়। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে দুই রকম আলোচনা বা গুঞ্জন আছে। একটি হচ্ছে ভোট নিয়ে ‘সন্দেহ’, যা সরকারের ওপর। অন্যটি হচ্ছে সরকারবিরোধীদের ‘ভোটের কৌশল’, যা বিএনপি-জামায়াত ঘিরে।
এই কৌশলের মূলে ছিল বিএনপি-জামায়াত ঘরানার ৬২ জন কাউন্সিলর প্রার্থী। দল দুটি নির্বাচন বর্জন করলেও তাদের সমর্থকেরা কাউন্সিলরকে ভোট দিতে গেলে তাঁরা মেয়রের ভোট কাকে দেবেন। এই সমীকরণে জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম সামনে আসেন। ভোটে দেখা গেল, ৪২টি ওয়ার্ডে বিএনপি-জামায়াতের ১২ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ৩ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর হয়েছেন। মূলত সরকারবিরোধীদের ভোট ভাগ হয়ে যায় মোটাদাগে তিন শিবিরে—যথাক্রমে নজরুল ইসলাম, শাহ জাহান মিয়া ও মাহমুদুল হাসানের মধ্যে। এর মধ্যে নজরুল ও শাহ জাহান পেয়েছেন ৮০ হাজার ভোট।
শাহ জাহান মিয়ার এত ভোটপ্রাপ্তির পর বলাবলি হচ্ছে, সরকারবিরোধী কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকেরা মেয়র পদে কাকে ভোট দেবেন, নজরুল ইসলাম, নাকি অন্য কেউ, এই প্রশ্নে কিছু দ্বিধায় ছিলেন। শেষ মুহূর্তে এসে অনেকে শাহ জাহানকে বেছে নেন নির্বাচনকে হালকা করতে। ফলে আলোচনার বাইরে থেকে অখ্যাত শাহ জাহান যে ভোট পেয়েছেন, তা সরকারবিরোধীদেরই ভোট।
অবশ্য পুরো নির্বাচনকেই ‘কারসাজি’ মনে করেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এসব ইভিএমের কারসাজি। বিভিন্ন প্রার্থীকে কিছু ভোট ভাগাভাগি করে দিয়ে জনসমক্ষে ভোটের একটা গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরার চেষ্টা চালানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ও সরকার যৌথভাবে এটা ঘটিয়েছে।