পারিবারিক সূত্রে জাতীয় পার্টিতে শেরীফা কাদের, আওয়ামী লীগে বিস্ময় হেনরী

আ.লীগের মনোনয়নে ভোটে ২১ জন নারী। জাপার নারী প্রার্থী ৯ জন। তাঁদের অনেকে পারিবারিক সূত্রে, অনেকে দীর্ঘদিনের রাজনীতিক।

এবার নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (জাপা) তাদের ২৬৩ জন প্রার্থীর মধ্যে শেরীফা কাদেরসহ ৯ জন নারীকে মনোনয়ন দিয়েছে। তবে জাপার নারী প্রার্থীদের মধ্যে একমাত্র শেরীফা কাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় ঢাকায় আসন পেয়েছেন। ঢাকা–১৮ আসনে প্রার্থী তিনি।

স্বামীর কারণে পারিবারিক সূত্রেই রাজনীতিতে নাম লেখান শেরীফা কাদের। তাঁর স্বামী জি এম কাদের জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হলে তিনি দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এখন তিনি সমঝোতার আসনে প্রার্থী।

তবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর জাপার বনানীর কার্যালয় ঘিরে বিক্ষোভ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থানসহ অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটে। এর আগে ডিসেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহে দফায় দফায় আলোচনায় জাপাকে ২৬টি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু ঢাকার কোনো আসনে ছাড় না দেওয়ায় জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, সে সময় এমন আলোচনাও চলছিল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগিতে শেরীফা কাদেরের ঢাকা-১৮ আসনটি নিশ্চিত হওয়ার পরই জাপা নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার ২৪ জন নারীকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিল। মনোনয়ন যাচাই-বাছাইয়ে একজন বাদ পড়েছেন এবং দুজন জোটের কারণে ভোট থেকে সরে গেছেন। যে ২১ জন ভোটের মাঠে আছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন দীর্ঘদিনের রাজনীতিক। আবার বাবা কিংবা স্বামীর কারণেও অনেকে ভোটে। জান্নাত আরা হেনরীসহ কারও কারও মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে দলের নেতাদেরও কেউ কেউ কিছুটা বিস্মিত।

রাজনীতিতে শেরীফা কাদের

পারিবারিক সূত্রে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) একের পর এক পদ পেয়েছেন শেরীফা কাদের। জি এম কাদেরের ভাই, জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী শেরীফাকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান করে গিয়েছিলেন।

এরপর জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা হওয়া থেকে শুরু করে তাঁর সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হওয়া, জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতির পদ, জাপার লালমনিরহাট জেলা সভাপতির পদ, দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ প্রেসিডিয়ামের সদস্যপদ, সর্বশেষ রাজধানীর ঢাকা-১৮ আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় প্রার্থী হওয়ার ঘটনা—সবকিছুই হয়েছে গত দুই–আড়াই বছরের ব্যবধানে।

জাপার দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, শেরীফা কাদের ক্রমেই দলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। এমনকি দলের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে দেশের ভেতরে-বাইরের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে অনেক গোপন বৈঠকেও তাঁকে থাকতে দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজধানী উত্তরায় তাঁর বাসস্থান। তবে ওই এলাকায় তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সেভাবে দেখা যায়নি।

পারিবারিক সূত্রে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) একের পর এক পদ পেয়েছেন শেরীফা কাদের। জি এম কাদেরের ভাই, জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী শেরীফাকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান করে গিয়েছিলেন।

শেরীফা কাদের প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের হাত ধরে তিনি ২০১০ সালে জাতীয় পার্টিতে আসেন। তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যানও হন। ছয় বছর চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ছিলেন। জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির সভাপতি হয়ে ৪৩ জেলায় সম্মেলন করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে কাজ দিলে আমি করতে পারি। সেটা কি আমার দোষ?’

জাপার সূত্রগুলো জানিয়েছে, শেরীফা কাদের দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) জাপা থেকে পদত্যাগ করার পর। সোহেল রানা রাজধানীর ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে (সাহারা খাতুনের মৃত্যুর পর) প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দলের মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষোভে-অভিমানে তিনি পদত্যাগ করেন।

সোহেল রানা জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ছাড়াও জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। তখন শেরীফা কাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির সভাপতি হন। এরপর গত দুই বছরে তিনি একের পর এক দলে উচ্চতর পদে আসীন হন। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতায় ঢাকা-১৮ আসন ভাগে পেয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলেন শেরীফা কাদের।

এ আসনে শেরীফার জন্য আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসানকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়। অথচ শেরীফা কাদেরের স্বামী ও জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ অন্তত পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ঢাকায় আওয়ামী লীগের আসন সমঝোতার জন্য অনেক দেনদরবার করেছিলেন। তাঁদের ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ।

এ বিষয়ে শেরীফা কাদের বলেন, ‘আমার স্বামী (জি এম কাদের) ১৯৯৬ সাল থেকে সংসদ সদস্য। চাইলে তো আরও আগেই সংসদ সদস্য হতে পারতাম।’

এবারের হলফনামা অনুসারে, হেনরীর বছরে আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা। হলফনামায় জান্নাত আরা দেখিয়েছেন, নিজের ও তাঁর স্বামীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মূল্য প্রায় ৬৬ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে দুজনের সম্পদ ছিল সাড়ে ১৩ লাখ টাকার কম।

হেনরীর মনোনয়নে বিস্ময় আওয়ামী লীগে

এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন জান্নাত আরা হেনরী। তিনি সিরাজগঞ্জ–২ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। ২০০৮ সালে সিরাজগঞ্জের সবুজ কানন উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা থেকে সরাসরি সংসদ নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তিনি। কিন্তু সেবার বিএনপির রুমানা মাহমুদের কাছে পরাজিত হন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন। তখন ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা ঘটনায় আলোচনায় আসে তাঁর নাম। এর মধ্যে আলোচিত ছিল হল–মার্ক কেলেঙ্কারি। সূত্রগুলো বলছে, বিভিন্ন পর্যায়ে পদ পাওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের বেশ কজন জ্যেষ্ঠ নেতার আশীর্বাদ পেয়েছেন হেনরী।

২০০৮ সালের শিক্ষক এখন পেশায় ঠিকাদার। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম মেসার্স লাম এন্টারপ্রাইজ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেওয়া হলফনামা অনুসারে, শিক্ষকতা পেশায় মাসে ১০ হাজার টাকা বেতনে বছরে আয় ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। কৃষি খাত থেকে আয় বছরে দুই হাজার টাকা। অর্থাৎ তাঁর বছরে আয় ছিল ১ লাখ ২২ হাজার টাকা। এবারের হলফনামা অনুসারে, হেনরীর বছরে আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা। হলফনামায় জান্নাত আরা দেখিয়েছেন, নিজের ও তাঁর স্বামীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মূল্য প্রায় ৬৬ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে দুজনের সম্পদ ছিল সাড়ে ১৩ লাখ টাকার কম।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে জান্নাত আরা হেনরীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলেননি।

২০১৪ সালে জান্নাত আরা দলীয় মনোনয়ন হারান। এই আসনে প্রথমবার মনোনয়ন পেয়ে পেশায় চিকিৎসক হাবিবে মিল্লাত সংসদ সদস্য হন। তিনি সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের জামাতা। ২০১৮ সালেও হাবিবে মিল্লাতে আস্থা রাখে আওয়ামী লীগ এবং জয়ী হন তিনি। এবার হাবিবে মিল্লাত বাদ পড়েন।

এ ছাড়া কক্সবাজার-৪ (টেকনাক-উখিয়া) আসনে মাদক ব্যবসায় নাম আসা এবং নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে আবদুর রহমান ওরফে বদিকে বাদ দিয়ে ২০১৮ সালে তাঁর স্ত্রী শাহীন আক্তারকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। শাহীন আক্তার এবারও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন।

এবারের হলফনামা অনুসারে, হেনরীর বছরে আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা। হলফনামায় জান্নাত আরা দেখিয়েছেন, নিজের ও তাঁর স্বামীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মূল্য প্রায় ৬৬ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে দুজনের সম্পদ ছিল সাড়ে ১৩ লাখ টাকার কম।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, তাঁদের দলের ২১ জন নারী প্রার্থীর অনেকে পারিবারিক সূত্রে মনোনয়ন পেয়েছেন এবং অনেকে উঠে এসেছেন রাজনীতির মাঠ থেকে।

জাতীয় সংসদের তিন শীর্ষ নেতা স্বাভাবিকভাবেই এবারও আওয়ামী লীগের হয়ে নৌকা প্রতীকে ভোটে আছেন। তাঁরা হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী।