জাতীয় সংসদ ভবন
জাতীয় সংসদ ভবন

দেখা দিতে পারে স্বার্থের দ্বন্দ্ব

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৯ সদস্যের মধ্যে ৬ জনই পেশায় ব্যবসায়ী। তাঁদের অন্তর্ভুক্তিতে এই কমিটিতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বা সংঘাত দেখা দিতে পারে। কারণ, জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি অনুযায়ী, এমন কোনো সদস্য সংসদীয় কমিটিতে নিযুক্ত হবেন না, যাঁর ব্যক্তিগত, আর্থিক ও প্রত্যক্ষ স্বার্থ কমিটিতে বিবেচিত হতে পারে, এমন বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে।

বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এবার বাণিজ্যসহ অন্তত ছয়টি কমিটিতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। অন্য পাঁচটি হলো শ্রম ও কর্মসংস্থান; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; নৌপরিবহন; প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য এস এম আল মামুনের রয়েছে জাহাজভাঙাশিল্পের ব্যবসা। এ কমিটির আরেক সদস্য শামীম ওসমান তৈরি পোশাক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

কোনো সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাজ হলো তার আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা করা। পাশাপাশি বিভিন্ন অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগের প্রশ্ন সামনে এলে তা তদন্ত করা। আইন পাসের জন্য সংসদে উত্থাপন করা বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেওয়া বা সুপারিশ করাও সংসদীয় কমিটির কাজ। তবে ২০১৪ সালে গঠিত দশম এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের পর গঠিত একাদশ সংসদে বেশির ভাগ সংসদীয় কমিটি ছিল নিষ্ক্রিয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরুর মাত্র পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে ৫০টি সংসদীয় কমিটি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি কমিটি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত। বাকি ১১টি কমিটি সংসদের বিভিন্ন বিষয়সম্পর্কিত।

কমিটিগুলোর মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সদ্য সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী তাঁর পেশা ব্যবসা (পোশাকশিল্প ও অন্যান্য)। এই কমিটির সদস্যদের মধ্যে শেখ হেলাল উদ্দিনের পেশা ব্যবসা ও রাজনীতি (ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া)। আর কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে শেখ আফিল উদ্দিন, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ ও মাহমুদ হাসান পেশায় ব্যবসায়ী। এ কমিটির একমাত্র নারী সদস্য সুলতানা নাদিরা মধুমতি টাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

ব্যবসা অনেকের আছে, যে কেউ ব্যবসা করতে পারেন। এখানে দেখতে হবে তাঁরা সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করছেন কি না।
নূর-ই-আলম চৌধুরী

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য এস এম আল মামুনের রয়েছে জাহাজভাঙাশিল্পের ব্যবসা। এ কমিটির আরেক সদস্য শামীম ওসমান তৈরি পোশাক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিম মাহমুদ হলফনামায় উল্লেখ করেছেন তিনি একজন আইনজীবী। সে সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক আইন ও জ্বালানিবিষয়ক পরামর্শক। এই কমিটির আরেক সদস্য আবদুর রউফের পেট্রলপাম্পের ব্যবসা রয়েছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য গোলাম কিবরিয়া লঞ্চ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়েছেন নিজাম উদ্দিন হাজারী। তিনি জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বলে জানা গেছে। জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) ওয়েবসাইটে ‘স্নিগ্ধা ওভারসিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিজাম উদ্দিন হাজারীর নাম রয়েছে।

ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত আছে, এমন কাউকে সংশ্লিষ্ট কমিটিতে না রাখলেই ভালো হতো। তবে একজন ব্যবসায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে থাকলে তিনি যে সব সময় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখবেন, তা না-ও হতে পারে। কমিটিগুলো পুরোদমে কাজ শুরু করলে বোঝা যাবে স্বার্থের সংঘাত কতটা হচ্ছে।
সংসদ বিষয়ে গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী (নোয়াখালী-৬) ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তিনি স্থানীয় সরকারের কাজও করে থাকেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

সংসদীয় কমিটিতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার ঝুঁকির বিষয়ে নূর-ই-আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসা অনেকের আছে, যে কেউ ব্যবসা করতে পারেন। এখানে দেখতে হবে তাঁরা সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করছেন কি না।

 

মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ে সভাপতি পদে

এবার ১২টি সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছে সদ্য সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের। যাঁরা আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদে এসেছেন এ কে আব্দুল মোমেন, অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হয়েছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি টিপু মুনশি, কৃষি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শ ম রেজাউল করিম, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি গোলাম দস্তগীর গাজী, ভূমি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাইফুজ্জামান চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বীর বাহাদুর উশৈসিং, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শরীফ আহমেদ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান।

সদ্য সাবেক ১২ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবার সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদে আসার বিষয়ে সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সদ্য সাবেক মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয়ে কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তাঁরা তাঁদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সংসদীয় কমিটিকে গতিশীল করতে পারবেন। এটি বরং ইতিবাচক।

যদি মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় (এখন কমিটির সভাপতি) কোনো অনিয়মের অভিযোগের বিষয় আসে, তখন স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে চিফ হুইপ বলেন, সংসদীয় কমিটিতে সভাপতি একা নন। আরও সদস্য আছেন। তাঁরা সে ক্ষেত্রে তদন্ত করতে পারবেন।

প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকে

দেশের সংসদীয় ইতিহাসে আগে মন্ত্রীরা সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। ১৯৯৭ সালে কার্যপ্রণালি বিধিতে পরিবর্তন আনা হয়। এর ফলে কোনো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে একই সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা যায় না। তবে সাবেক মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির সভাপতি করার বিষয়ে কার্যপ্রণালী বিধিতে কোনো বাধা নেই। মূলত দশম সংসদ থেকে সদ্য-সাবেক মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির সভাপতি করার প্রবণতা বাড়তে শুরু করে।

‘বাংলাদেশে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যকরতা: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন ২০১৫ সালে প্রকাশ করেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ওই প্রতিবেদনে টিআইবি বলেছে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নবম সংসদের ছয়টি স্থায়ী কমিটিতে একাধিক সদস্যের কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা ছিল। আর ২০১৪ সালের দশম সংসদের পাঁচটি স্থায়ী কমিটিতেও একাধিক সদস্যের কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা ছিল।

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক স্থায়ী কমিটিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সদস্য থাকায় এবং কিছু ক্ষেত্রে সাবেক মন্ত্রী সভাপতি হওয়ায় কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকে বলে টিআইবি ওই প্রতিবেদনে বলেছিল।

সংসদ বিষয়ে গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সদ্য সাবেক মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি করাতে সুবিধা-অসুবিধা দুটিই আছে। সুবিধা হচ্ছে, তাঁরা মন্ত্রণালয়ের কাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু বড় অসুবিধা হলো প্রথম দিকে সংসদীয় কমিটিকে কাজ করতে হবে গত মেয়াদে মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো নিয়ে। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়মের বিষয় এলে হয়তো তদন্ত হবে না। এটি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। কোনো নীতিও হয়তো সংসদীয় কমিটিতে ‘ক্রিটিক্যালি’ (সমালোচনার দৃষ্টিতে) আলোচনা করা হবে না।

সংসদ বিষয়ে গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত আছে, এমন কাউকে সংশ্লিষ্ট কমিটিতে না রাখলেই ভালো হতো। তবে একজন ব্যবসায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে থাকলে তিনি যে সব সময় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখবেন, তা না-ও হতে পারে। কমিটিগুলো পুরোদমে কাজ শুরু করলে বোঝা যাবে স্বার্থের সংঘাত কতটা হচ্ছে।