জেলার রাজনীতি—৮ 

কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগ–বিএনপিতে কোন্দল, শান্তিতে নেই জাসদ

বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়েছে আওয়ামী লীগ ও জাসদ। প্রায়ই ঘটে দুই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা।

কুষ্টিয়া জেলায় সংসদীয় আসন চারটি। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এই চার আসনই ছিল বিএনপির দখলে। তখন কুষ্টিয়াকে বিএনপির দুর্গ বলা হতো। সর্বশেষ তিনবারের জাতীয় নির্বাচনে এই জেলা আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। একটানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সর্বত্রই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগের মুখোমুখি এখন আওয়ামী লীগই। তৃণমূল নেতারা বলছেন, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দলের নেতাদের বিরোধ এখন তুঙ্গে। এটা নিরসন করা না গেলে আগামী নির্বাচনে দলের জন্য ক্ষতি হবে।

অপরদিকে বিএনপি হামলা-মামলায় জর্জরিত। দলটির নেতা-কর্মীরা বিচ্ছিন্ন। অন্তত ১৫০ রাজনৈতিক মামলা নিয়ে তাঁরা আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত। এত দিন দলীয় কর্মকাণ্ড তেমন ছিল না। তবে ১০ দফা এবং পরে এক দফার আন্দোলনকে ঘিরে কয়েক মাস ধরে তাঁরা মাঠে আছেন। সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় প্রার্থী হতে বিরোধেও জড়িয়েছেন তাঁরা।

কুষ্টিয়ায় এই দুই দলের বাইরেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জাসদ) ভালো নেই। তাঁদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রায়ই ঘটে দুই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা।

আওয়ামী লীগে হানিফই সব

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের জন্মস্থান ভেড়ামারা। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে হানিফ কুষ্টিয়া-২ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসনে নির্বাচন করে পরাজিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে নৌকার প্রার্থী করা হয়। হানিফ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পান।

২০১৪ সালে হানিফ কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন। এরপর থেকে জেলা শহর ও উপজেলাগুলোর দলীয় নেতা-কর্মীরা তাঁর অনুসারী হতে থাকেন। তাঁর চাচাতো ভাই আতাউর রহমানও ভেড়ামারা ছেড়ে কুষ্টিয়া শহরে এসে পৌর আওয়ামী লীগের পদ পান। পরে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। ধীরে ধীরে জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি হানিফের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

তৃণমূলের নেতারা বলছেন, জেলায় দলের ভেতরে এমপিরা নিজস্ব পক্ষ সৃষ্টি করেছেন। এ কারণে দলের মধ্যে বিভেদ চলছে। সম্প্রতি দেখা গেছে, হানিফের কোনো অনুষ্ঠানে জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা যাচ্ছেন না। এই বিরোধের জেরে সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। সদর উপজেলায় ১৩টি ইউপির দুটিতে নৌকার প্রার্থী জয় পান। ৯টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও দুটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। ইউপি নির্বাচনে নৌকার এই বিপর্যয়ের পেছনে হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান দায়ী করা হয়। তিনিই সর্বত্র বিভক্তি সৃষ্টি করেছেন।

নাম প্রকাশ না করে জেলার এক নেতা বলেন, সদরে সবকিছু এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন আতাউর রহমান। এতে জেলা ও উপজেলার শীর্ষ কয়েকজন নেতা অভিমান করে হানিফের অনুষ্ঠানে যান না। এটা বেশ কয়েক বছর ধরে হয়ে আসছে।

১৬ সেপ্টেম্বর রাতে মাহবুব উল আলম হানিফের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। তিনি বছেন, ‘এগুলো স্থানীয় নেতারা বলবেন।’ তিনি শুধু বলেন, তৃণমূলের কর্মীদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। তাঁদের যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো নিরসন করা হচ্ছে। সবাই এক হয়ে কাজ করছেন। কোথাও কোনো বিরোধ নেই।

দৌলতপুরের ১৪টি ইউপির মধ্যে চারটিতে নৌকার প্রার্থী জয় পান। ৯টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং একটিতে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হন। কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের এমপি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম সরওয়ার জাহানের সঙ্গে সাবেক এমপি ও উপজেলা কমিটির সহসভাপতি রেজাউল হক চৌধুরীর বিরোধ রয়েছে। তাঁরা দলীয় অনুষ্ঠান আলাদাভাবে পালন করেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একে অপরের বিরুদ্ধে বক্তব্যও দেন। এই আসনে রেজাউল হক আবার প্রার্থী হতে চান। তাঁর ছোট ভাই উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বুলবুল আহমেদও প্রার্থী হতে মাঠে কাজ করছেন।

কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনের এমপি সেলিম আলতাফে (জর্জ) সঙ্গেও জেলা ও উপজেলার জ্যেষ্ঠ নেতাদের রয়েছে তীব্র বিরোধ। সেলিমের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দীন খান, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাহিদ হোসেন (জাফর) এবং কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান খান। এই নেতারা কয়েক বছর ধরে এমপিকে ছাড়াই কুমারখালী ও খোকসায় সভা-মতবিনিময় করেন।

বিরোধের কারণ হিসেবে স্থানীয় নেতারা বলছেন, সেলিম আলতাফ শুধু তাঁর চাচা কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুজ্জামান অরুণকে নিয়ে থাকেন। সেলিম বয়সে তরুণ। তাই তাঁকে বয়োজ্যেষ্ঠরা মানতে পারেন না বলে তাঁর অনুসারীরা জানান।

সদর উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, কিছু কিছু জনপ্রতিনিধির সঙ্গে দলের তৃণমূল নেতাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলো
না মেটানো গেলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে। আর তূণমূল মতামতের ভিত্তিতে এবং দল ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এমন নেতাকে যেন মনোনয়ন দেওয়া হয়। তাহলেই দুর্গ টিকিয়ে রাখা যাবে।

বিএনপিতে দ্বন্দ্ব, মামলার চাপ

পুরোনো ঘাঁটি উদ্ধার করবে কি কুষ্টিয়ায় বিএনপিতে চলছে নেতৃত্বের সংকট ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল। আওয়ামী লীগ ও পুলিশের চাপেও কোণঠাসা স্থানীয় বিএনপির নেতা–কর্মীরা। জেলায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা অন্তত ১৫০টি। এসব মামলায় মোট আসামি অন্তত পাঁচ হাজার। বিভিন্ন সময়ে শতাধিক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বর্তমানে কারাগারে আছেন নয়জন। বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এতটাই এলোমেলো হয়ে পড়েছে যে কয়েক বছর মাঠে নামতে পারেননি নেতা-কর্মীরা। কেন্দ্রঘোষিত সব কর্মসূচি ঘরোয়াভাবে পালন করেছেন। ফটোসেশন ছাড়া এসব কর্মসূচি মাঠে প্রভাব ফেলতে পারেনি।

দলীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, ২০১৩ সালের পর চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত বিএনপির ব্যানারে কুষ্টিয়ায় বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ সভা বা কেন্দ্রঘোষিত কোনো কর্মসূচি করতে পারেনি দলীয় নেতৃত্ব। দলের মধ্যে একাধিক ধারা থাকায়, শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কোন্দল ও যোগ্যদের মূল্যায়ন না হওয়ায় নেতা–কর্মীদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিন বছর জেলা কমিটির কোনো সভা হয়নি। আন্দোলন–সংগ্রামে মাঠে নামতে পারেননি। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সোহরাব উদ্দিনের সঙ্গে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন সরকারের বিরোধ। দুজনই সদর আসনে প্রার্থী হতে চান। দুজনেরই আলাদা পক্ষ রয়েছে। বাকি আসনগুলোতেও বিরোধ রয়েছে।

জেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, দলের মধ্যে ব্যাপক বিরোধ। সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। এগুলো দ্রুত কাটিয়ে উঠে দলকে বেগবান করা প্রয়োজন। সাংগঠনিক সম্পাদক শামীমুল হাসান বলেন, দলে সমস্যা আছে। প্রতিযোগিতার নামে কিছু নেতা দলকে বিভ্রান্ত করছেন।

কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সোহরাব উদ্দিন বলেন, ‘হামলা, মামলা ও আদালতের বারান্দায় ঘুরতেই বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। সরকারের চাপে বিগত কয়েক বছর দলীয় কার্যালয়েও বসতে পারিনি। গত তিন মাস সেটা স্বাভাবিক হয়েছে। বড় দল হিসেবে কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। কিছু জায়গায় নেতাদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। সেটা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে। কেন্দ্রের নির্দেশ পেলে আগামী নির্বাচনের জন্য তৃণমূলসহ সবাই প্রস্তুত রয়েছে।’

জোটে জাসদ কষ্টে

কুষ্টিয়ার রাজনীতিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একটি সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে থাকায় জাসদের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাসানুল হক ইনু কুষ্টিয়া-২ আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য। এই আসনে জাসদের নেতা-কর্মী বেশি। জেলা-উপজেলায় নিজ দলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে তেমন কোনো বিরোধ নেই। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ব্যাপক বিরোধ। গত ১৫ বছরে হামলা, মামলা, হত্যা, মারামারি—সবই ঘটেছে জোটের শরিক এই দুই দলের মধ্যে। যদিও জাসদ বরাবরই বলে আসছে স্থানীয় সমস্যায় এসব ঘটে। এখানে দলের কোনো বিষয় নয়।

জানতে চাইলে জেলা জাসদের সভাপতি গোলাম মহসিন প্রথম আলোকে বলেন, জাসদ কুষ্টিয়া খুবই সুসংগঠিত। কোনো বিরোধ নেই। জোটেও কোনো সমস্যা নেই। আগামী নির্বাচনের জন্য জাসদ প্রস্তুত রয়েছে।