যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসানের বিরুদ্ধে ভোটের প্রচারে নেমেছেন গাজীপুর সিটির সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।
সাত মাস আগে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে নিজের মা জায়েদা খাতুনকে জিতিয়ে আনেন জাহাঙ্গীর আলম। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা জায়েদা খাতুন ভোটে হারিয়েছেন নৌকার প্রার্থীকে। এবার গাজীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী আলিম উদ্দিনকে ভোটে জয়ী করতে প্রচারে নেমেছেন গাজীপুর সিটির সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর।
এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান (রাসেল)। স্থানীয় রাজনীতিতে আলোচনা আছে, এবারের নির্বাচনে জাহিদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আসলে কাজী আলিম নন জাহাঙ্গীর আলম। যে কারণে শুরু থেকেই নির্বাচনী প্রচারে জাহাঙ্গীরের সমালোচনা করছেন জাহিদ আহসান। নৌকার প্রার্থীর কর্মকাণ্ড তুলে ধরে পাল্টা সমালোচনা করছেন জাহাঙ্গীরও।
একাধিকবার বহিষ্কৃত হওয়ার পর আবারও দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে মাঠে নামা প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনকে একটা সুন্দর ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন উপহার দিতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমেছি। এটাকে যেন কেউ ভুলভাবে ব্যাখ্যা না দেন।’
দলীয় সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ আহসানের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের বিরোধের শুরু ২০২১ সালে। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কারও সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
২০০৪ সাল থেকে গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান। এই আসনে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলিম উদ্দিন। তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৫টি ওয়ার্ড ও গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে এই আসন গঠিত। ভোটার প্রায় ৭ লাখ ৮০ হাজার। নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের প্রার্থী ছাড়াও এখানে আরও ৭ প্রার্থী আছেন। তবে তাঁদের জোরালো কোনো প্রচার নেই।
গাজীপুর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ১০ জন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, প্রচারের শুরুতে স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী আলিমকে নিয়ে সাধারণ মানুষের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তাঁর পক্ষে জাহাঙ্গীর আলম মাঠে নামায় পরিস্থিতি বদলে গেছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান। জায়েদা প্রার্থী হলেও ভোটের লড়াইয়ে কার্যত আজমত উল্লার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাহাঙ্গীর। মায়ের পক্ষে দিন-রাত প্রচার চালান তিনি। ভোটে জায়েদা খাতুন ১৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেন নৌকার প্রার্থীকে।
আমরা প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনকে একটা সুন্দর ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন উপহার দিতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমেছি। এটাকে যেন কেউ ভুলভাবে ব্যাখ্যা না দেন।জাহাঙ্গীর আলম
এবার সংসদ নির্বাচনে জাহাঙ্গীর স্বতন্ত্র প্রার্থী আলিম উদ্দিনের পক্ষে গণসংযোগ করে ভোট চাইছেন। কাজী আলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম প্রচারে আমার পাশে আছেন।’
দলীয় সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ আহসানের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের বিরোধের শুরু ২০২১ সালে। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কারও সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জাহাঙ্গীরের বিতর্কিত বক্তব্যের ওই অডিও ক্লিপ প্রকাশ পাওয়ার পর সরকার ও দলের ভেতর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জোরালো হয়। জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কার করার দাবিতে গাজীপুরের যে কয়েকজন নেতা জোরালো ভূমিকা রাখেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান। নেতা-কর্মীদের দাবির মুখে জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। একপর্যায়ে তিনি মেয়রের পদও হারান। পরে তিনি ক্ষমা চান, দলও তাঁকে ক্ষমা করে।
ওই বিরোধের জের ধরে জাহাঙ্গীর এবার সংসদ নির্বাচনে জাহিদ আহসানের বিপক্ষে নেমেছেন বলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে। তবে জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাহিদ আহসানের সঙ্গে আমার শত্রুতা নেই। তিনি ১৮ বছর ধরে ক্ষমতায়, কিন্তু এলাকার উন্নয়নকাজ করতে পারেননি।’
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম প্রচারে আমার পাশে আছেন।কাজী আলিম উদ্দিন
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন জাহিদ আহসান। মাঝে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বিনা ভোটে জয়ী হন তিনি। গত তিনটি নির্বাচনে সে অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয়নি তাঁকে।
এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী আলিম উদ্দিনের পেছনে জাহাঙ্গীর আলম থাকায় ভোটের চিত্র পাল্টে গেছে। বিষয়টি নিয়ে নৌকার প্রার্থী ও তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা সতর্ক। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, জাহাঙ্গীর মেয়র পদে আজমত উল্লা খানকে যেভাবে হারাতে পেরেছেন, জাহিদ আহসানের ক্ষেত্রে তা সহজ হবে না।
টানা ১৮ বছর এই আসনের সংসদ সদস্য থাকায় এলাকায় তাঁর প্রভাব ও নিজস্ব লোকবল রয়েছে। আর গত সিটি নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনের প্রতি ভোটারদের সহানুভূতিও কাজ করেছিল। স্বতন্ত্র প্রার্থী আলিম উদ্দিনের ক্ষেত্রে ভোটারদের বিশেষ কোনো দুর্বলতা নেই।
দলের আলোচনা রয়েছে, একাধিক আসনে নিজের প্রার্থীদের জেতাতে পারলে পুরো গাজীপুরে জাহাঙ্গীরের একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। এমন পরিকল্পনা থেকেই তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর বিষয়টি এড়িয়ে যান।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে জাহাঙ্গীর আলমের প্রচার চালানোর বিষয়ে জাহিদ আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলম কুরুচিপূর্ণ কথা ছড়াচ্ছেন, মিথ্যাচার করছেন। আমরা পাল্টা খারাপ কথা বা লাঠিসোঁটা নিয়ে এর কোনো প্রতিবাদ করতে চাই না৷ মানুষ ভোটের মাধ্যমে সবকিছুর জবাব দেবে।’
শুধু গাজীপুর-২ আসনেই নয়, জাহাঙ্গীর আলম জেলার অন্য দুটি আসনেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন দিচ্ছেন। গাজীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম এবং গাজীপুর-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও গাজীপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামানের পক্ষে কাজ করছেন জাহাঙ্গীর।