সরকারবিরোধী আন্দোলনের কোনো একটা পর্যায়ে বিএনপি ও সমমনা বিরোধী দলগুলো ঢাকায় বিপুলসংখ্যক লোক নিয়ে বসে পড়তে পারে—এই আশঙ্কা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। আর বিএনপি একবার বসে যেতে পারলে তখন দলটি সরকারের পতনের দাবিতে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিতে চলে যেতে পারে। এমন একটা ধারণা থেকেই পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে ‘সতর্ক পাহারায়’ আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন হচ্ছে, বিরোধীদের কৌশলের পাল্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ রাজপথে শক্ত অবস্থান নেওয়ায় বিএনপি এখনো সে রকম কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত বিএনপির যে অবস্থান, তাতে দলটি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। সে ক্ষেত্রে তারা ভোট পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখলে আওয়ামী লীগও একই কায়দায় রাজপথে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখবে। এতে দলের কর্মীরা চাঙা থাকবেন। পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও হয়ে যাবে।
বিএনপির আগুনসন্ত্রাসসহ অতীত কর্মকাণ্ড তো দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। তাদের ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ কীভাবে নিশ্চিন্তে থাকে?মতিয়া চৌধুরী, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আ.লীগ
রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দলের পাশাপাশি সরকারেরও অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন রয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, সরকারের টানা ১৪ বছরের শাসনামলে কখনো রাজধানী ঢাকার রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি বিএনপি। বর্তমান সরকার দীর্ঘ সময় নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকার পেছনে এটা একটা বড় কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ঢাকায় অবস্থান নিতে পারলে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে সরকারের সক্ষমতা নিয়ে যে আস্থা রয়েছে, তাতে চিড় ধরতে পারে। সরকার দুর্বল বা পতন হয়ে যেতে পারে—-এ ধরনের একটা ধারণা তৈরি হতে পারে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষও বিএনপির কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারে। এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।
এ ছাড়া বিএনপির এবারের আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে বিদেশি প্রভাবশালী কিছু দেশের আগ্রহ দেখছে আওয়ামী লীগ। সম্ভবত প্রভাবশালী দেশগুলোও বিএনপিসহ সরকারবিরোধীদের শক্তি দেখতে চাইছে। এ জন্যে আগাম সতর্কতা হিসেবে পাল্টা সমাবেশের মাধ্যমে পাহারা জোরদার করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা বলছেন, এর মাধ্যমে একদিকে বিএনপিকে চাপে রাখা যাচ্ছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যে সরকারের পাশাপাশি রাজপথে শক্তিশালী, এটাও দেখানো গেছে।
১৪ বছর ধরেই তো বিএনপি রাজপথে সুবিধা করতে পারছে না। এখন কেন শঙ্কা তৈরি হলো? এ প্রশ্নে আওয়ামী লীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়া, বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে বাধা না দেওয়া এবং নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য কিছুটা চাপ আছে সরকারের ওপর। এ জন্য এখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে বিএনপির আন্দোলন দমন করতে চাইছে না সরকার। এ ছাড়া র্যাবের সাতজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং আরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে—এমন আলোচনাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কিছুটা রয়ে-সয়ে ব্যবহারের পেছনে কাজ করেছে। এ জন্য বিরোধী দলকে যতটা সম্ভব রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় জোর দেওয়া হয়েছে।
ওই নেতারা আরও বলেন, বিএনপি এরপরও সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিলে আওয়ামী লীগের পাল্টা কর্মসূচির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হবে। যেমন গত ১০ ডিসেম্বর ঘিরে একধরনের আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছিল বিএনপি। এ জন্য দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যুগপৎভাবে মাঠে নেমেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রসচিব ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফরে এসে সরকারকে সেভাবে চাপ দেননি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের কৌশল সফল।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির আগুনসন্ত্রাসসহ অতীত কর্মকাণ্ড তো দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। তাদের ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ কীভাবে নিশ্চিন্তে থাকে? এ ছাড়া তারা প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার করছে। এর জবাব দেওয়া দরকার। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কর্মসূচি বিএনপির চেয়ে অনেক দূরে হচ্ছে। বিএনপি পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া না লাগালে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত বিরোধী দলের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের কৌশলের মূল দিক দুটি। প্রথমত, বিএনপি যেখানেই সংগঠিত হতে চাইবে, পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে হাজির থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঢাকায় বেশি জোর দেওয়া হবে। দ্বিতীয়ত, আগ বাড়িয়ে সংঘাতে জড়ানো যাবে না। শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখবে। আওয়ামী লীগের কর্মীদের শুধু বিএনপিকে চাপে রাখতে এবং ভয় দেখাতে রাজপথে থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত ছক মেনেই আওয়ামী লীগের কৌশল এগিয়েছে বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এই কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
আওয়ামী লীগ মনে করছে, ২০১৩-২০১৫ সালে বিএনপি ঢাকার বাইরে অনেক জায়গা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েও সফল হয়নি। কারণ, ঢাকার নিয়ন্ত্রণ তারা নিতে পারেনি। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে বড় শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপিকে চাপে রেখেছে। তাই ঢাকায় সর্বাত্মক জোর দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে ঢাকার বাইরে সংগঠিত যাতে না হতে পারে, সেখানেও চাপ অব্যাহত রাখা হবে।
এখনো নির্বাচনের বছরখানেক সময় রয়েছে। এই লম্বা সময়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া কতটা সম্ভব?
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি ভোটে না এলে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি সংঘাতে রূপ নিতে পারে। কারণ, বিএনপি হয়তো আগামী রোজার পর আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার কথা ভাবছে। তখন দুই পক্ষের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হতে পারে। এতে সংঘাতের আশঙ্কা থাকছেই।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সভাপতিমণ্ডলী, কার্যনির্বাহী সংসদ, জাতীয় কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদ—এ ধরনের ফোরাম রয়েছে। গঠনতন্ত্র মোতাবেক দলের অভ্যন্তরীণ, দেশের, এমনকি বৈদেশিক সম্পর্কসংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় এসব ফোরামে আলোচনা হওয়ার কথা।
কিন্তু বিএনপির পাল্টা হিসেবে সভা-সমাবেশ করার বিষয়ে দলের কোনো ফোরামে আলোচনা হওয়ার কথা বলতে পারছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁরা বলছেন, দলের ফোরামে শুধু দিবসভিত্তিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়, অনুমোদন দেওয়া হয়। রাজনৈতিক কৌশলগত বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হওয়ার সাম্প্রতিক নজির খুব একটা নেই। দলীয় প্রধানের নানা বক্তব্য থেকে নেতারা ‘বার্তা’ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির পাল্টা হিসেবে সভা-সমাবেশের সিদ্ধান্তটি দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দু-একজন নেতা জানতেন। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্ব স্ব ইউনিটগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করেছেন দলের সাধারণত সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সচিবালয়ে তদবির, উন্নয়নমূলক কাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, জমি দখল, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া—এসবই আওয়ামী লীগের নেতাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। এখন বিএনপি রাজপথে নামার পর প্রতিপক্ষ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের পাল্টা কর্মসূচির প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন দলটির নেতাদের অনেকে। তাঁরা বলছেন, নভেম্বরে বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ শুরুর পর টানা দু-তিন দিন ধরে বিএনপির সংবাদ গণমাধ্যমে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। আওয়ামী লীগ পাল্টা সমাবেশ শুরু করলে প্রচার ভাগাভাগি হয়। এখন তো আওয়ামী লীগের প্রচারই বেশি হচ্ছে। পাল্টা সমাবেশ না করলে সেটা হতো না।
গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা রাজপথে অবস্থান নেন। এরপর থেকেই মূলত পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির সূচনা হয়।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনীতিতে মাঠ দখলে রাখা তো সাধারণ রেওয়াজ। বিএনপি মাঠ দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমরা তাদের সেই সুযোগ দিচ্ছি না।’