ভোটব্যাংক বিষয়টির সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ বেশ পরিচিত। ‘ভোট চুরি’ কী, সেটিও মানুষ জানে। একইভাবে রাজনৈতিক দলে ‘পকেট কমিটি’ বলতে কী বোঝায়, সেটিও ভালোই বুঝতে পারে মানুষ। বছর চারেক আগে নতুন একটা বিষয়ের সঙ্গে দেশের মানুষ পরিচিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে ‘রাতের ভোট’। সর্বশেষ জানা গেল, দিনের ভোট বা রাতের ভোটই শুধু নয়, পকেটেও ভোট থাকে।
সেই ‘পকেট’ এতই বড় যে আট–দশটা নয়, সেখানে দুই কোটি ভোট থাকে। এটি কোনো বানানো কথা নয়। জাতীয় সংসদের মাধ্যমে দেশের মানুষকে বিষয়টি জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ। গত মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় ঢাকা-১১ আসনের এই সংসদ সদস্য জানান, তিনি আহলে হাদিসের প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর পকেটেই আহলে হাদিসের দুই কোটি ভোট আছে।
আমার পকেটেই আহলে হাদিসের দুই কোটি ভোট আছে।এ কে এম রহমতুল্লাহ , সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ
টেবিলে চুরি করে, বাতাসে চুরি করে এবং এখানের (সিটি করপোরেশন) মধ্যে সব চোর।এ কে এম রহমতুল্লাহ , সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্যের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় সংসদে আহলে হাদিসের অনুসারী প্রায় ৩০ জন সংসদ সদস্য আছেন। তবে অনেকে পরিচয় দেন না। কোনো সংসদ সদস্য যখন জাতীয় সংসদে দায়িত্ব নিয়ে ‘সুনির্দিষ্টভাবে’ কিছু তুলে ধরেন, সেটিকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই।
পকেটে থাকা দুই কোটি ভোট নির্বাচনের সময় কোন পক্ষে যাবে, সেটিও বলে দিয়েছেন সংসদ সদস্য রহমতুল্লাহ। তিনি নিজেকে আহলে হাদিসের দুই কোটি ভোটের ‘চিফ অ্যাডভাইজার’ (প্রধান উপদেষ্টা) দাবি করে সংসদে আরও বলেছিলেন, তিনি যেদিকে যাবেন, ওই ভোটও সেদিকে যাবে।
‘পকেটে ভোট’–এর মতো নতুন কথা জাতিকে শোনানোর কারণেই শুধু নয়, সংসদ সদস্য রহমতুল্লাহ আরও একটি কারণে ধন্যবাদ পেতে পারেন। দেশের কোথায় চুরি–দুর্নীতি বেশি হয়, সে সম্পর্কেও তিনি কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। একই সঙ্গে মন্ত্রী–মেয়র হলে সৎ থাকা যায় কি না, সে প্রশ্নও সবার সামনে এনেছেন তিনি। এই যুগে ‘ফুলের মতো পবিত্র’ নেতাদের পক্ষেও নিজেদের সৎ দাবি করা কঠিন। কিন্তু পবিত্র সংসদে নিজেকে সৎ লোক উল্লেখ করে রহমতুল্লাহ সংসদে বলেছিলেন, অনেকে তাঁকে প্রশ্ন করেন, কেন তাঁকে মিনিস্টার বা মেয়র করা হয়নি। এই প্রশ্নের উত্তর সংসদেই দিয়েছেন তিনি।
মন্ত্রী–মেয়রের পদে গেলে সৎ লোক হিসেবে টিকে থাকা কঠিন, এমন আশঙ্কা থেকে ‘অফার’ থাকা সত্ত্বেও ওই সব পদে যেতে চাননি—এমন কথা গত রোববার (২৯ জানুয়ারি) সংসদে বলেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা রহমতুল্লাহ। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁকে মেয়র (অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের) করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেখানকার (সিটি করপোরেশন) টেবিল, বাতাস থেকে শুরু করে সব চোর। এ কারণে তিনি ওই পদে যাননি। এমনকি তাঁকে মন্ত্রী হওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছিল, কিন্তু এসব কারণে তাতেও রাজি হননি তিনি।
রহমতুল্লাহর ভাষায়, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই, হানিফ সাহেব (ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) মারা যাওয়ার পর মেয়র অফার (প্রস্তাব) করেছিলেন। আমি আপারে বললাম, ওখানে যাব না। এখানে টেবিলে চুরি করে, বাতাসে চুরি করে এবং এখানের মধ্যে সব চোর। আমি যাব না।’
রহমতুল্লাহ যখন ‘চোরদের ভয়ে’ মন্ত্রী–মেয়র হওয়া থেকে নিজেকে ‘বিরত’ রাখতে চান, তখন ভোটের ফল ‘ছিনতাই’ হয়ে যাওয়ার কারণে সংসদ সদস্য হতে না পারায় নিজের ক্ষোভ–আক্ষেপের কথা বললেন হিরো আলম নামে পরিচিতি পাওয়া বগুড়ার যুবক আশরাফুল হোসেন। নানা কারণে আলোচিত হওয়া বগুড়ার প্রত্যন্ত এরুলিয়া গ্রামের এই যুবক একসময় সিডি বিক্রি করতেন। সেই সিডি যখন চলছিল না, তখনই কেব্ল সংযোগ ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেই ব্যবসার সুবাদে মিউজিক ভিডিও বানাতে থাকেন। এসব ভিডিওতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি, এমনকি নির্দেশনাও দেন তিনি। ইউটিউবে প্রায় ৫০০ মিউজিক ভিডিও ছাড়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন হিরো আলম। প্রথম দিকে তাঁর ভিডিও নিয়ে কৌতুক শুরু হয়। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ভিডিও নিয়ে ‘ট্রল’ হয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি। এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি দেশের অন্যতম আলোচিত মুখ।
জাতীয় সংসদের ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে বগুড়া-৪ ও ৬ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন হিরো আলম। গতকাল বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘সদরের (বগুড়া-৬) কেন্দ্র সব দখল হয়্যা গ্যাচে। ডিসি-এসপিক কয়্যাও কোনো কাম হচ্চে না। সদরের আশা সব শ্যাষ।’ তবে বগুড়া-৪ আসনে ভোট গ্রহণ সুষ্ঠু হচ্ছে জানিয়ে তখন তিনি বলেছিলেন, ‘কাহালু-নন্দীগ্রামের অনেক কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেকচি। ভোট খুব সুষ্ঠু হচ্চে। মাঠের অবস্থা খুবই ভালো। কাহালু-নন্দীগ্রামের নিশ্চিত এমপি হচ্চি।’
ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, বগুড়া-৪ আসনে মহাজোটের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনের কাছে ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন হিরো আলম। একতারা প্রতীকে হিরো আলম পেয়েছেন ১৯ হাজার ৫৭১ ভোট। নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ২৩ দশমিক ৯২।
তবে ভোটের ফলাফল গণনা শেষে বগুড়া শহরতলির এরুলিয়ায় নিজ বাড়িতে ১ ফেব্রুয়ারি রাতে সংবাদ সম্মেলনে হিরো আলম বগুড়া–৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচনে ফল পাল্টানোর গুরুতর অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, ‘বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। তবে ফলাফলে এসে গন্ডগোল করেছে। নির্বাচন কমিশন আমার বিজয় ছিনতাই করে মশালের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে।’
ফল পাল্টানোর কারণ কী, এমন প্রশ্নের জবাবে হিরো আলম বলেন, ‘শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক আছেন, যাঁরা আমাকে মেনে নিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, আমি পাস করলে বাংলাদেশের সম্মান যাবে, তাঁদের সম্মান যাবে। আমরা এত শিক্ষিত, হিরো আলমের মতো মূর্খকে স্যার বলে ডাকতে হবে। এ জন্য তাঁরা আমাকে মানতে চান না। তাঁরা আমার বিজয় মেনে নিতে পারেননি। নির্বাচন নিয়ে এ রকম প্রহসন হলে, কারচুপি হলে মানুষ নির্বাচন ভুলে যাবে।’
ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো