জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বনানী কার্যালয়ে জাতীয় কৃষক পার্টির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন। ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর
জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বনানী কার্যালয়ে জাতীয় কৃষক পার্টির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন। ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর

‘ব্ল্যাকমেইল’ ও ‘বাধ্য করা’র অভিযোগ তুলে সাত নির্বাচনে জাপার ভূমিকার ব্যাখ্যা দিলেন জি এম কাদের

জাতীয় পার্টি (জাপা) ‘কখনো কারও দোসর ছিল না’ বলে দাবি করেছেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এ বিষয়ে তিনি ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত জাতীয় পার্টির ভূমিকা কোন পরিস্থিতিতে কী হয়েছে, তা তুলে ধরেন। ২০২৪-এর নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল বলে দাবি করে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচন হতো না বা নির্বাচন বৈধতা পেত না, এ রকম পরিস্থিতি ছিল না।’

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ে জাতীয় কৃষক পার্টির নেতাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় জি এম কাদের এ কথা বলেন।

জি এম কাদের বলেন, ‘আমরা সব সময় জনগণের সঙ্গে ছিলাম। কখনো কারও দোসর ছিলাম না। আমরা সব সময় জনগণের জন্য কাজ করেছি। যার জন্য ৩৭ বছর পরও জাতীয় পার্টি জনগণের কাছে টিকে আছে। আমরা যেকোনো সময় যেকোনো নির্বাচনে গেলে ভালো ফল করব।’

১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে জি এম কাদের বলেন, ‘৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, আমরা সবাই আলাদাভাবে নির্বাচন করেছি। সরকার গঠনের সময় যেহেতু জনগণ বিএনপির পক্ষে ছিল না, তাই আমরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিলাম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিভিন্নভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন আমাদের মাঠে নামতে দেয়নি, আমাদের পার্টি অফিস ভেঙে দিয়েছে, আক্রমণ করে আমাদের সভা পণ্ড করে দিয়েছে, সমাবেশে ১৪৪ ধারা জারি করেছে।’

জি এম কাদের বলেন, ‘১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হলে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল। তখন আমরা চার দলীয় জোট করেছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ একটি মামলা দিয়ে এরশাদ সাহেবকে জেলে আটকে রেখে ব্ল্যাকমেইল করে।’

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এসে দুর্নীতিতে চারবার চ্যাম্পিয়ন হয় উল্লেখ করে জি এম কাদের বলেন, তারা (বিএনপি) র‌্যাব তৈরি করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু করে, যা আওয়ামী লীগের শেষ দিন পর্যন্ত চলমান ছিল। বিএনপির আমল থেকেই দলীয় প্রশাসনে নিজস্ব ব্যবসায়িক বলয় তৈরি করা শুরু হয়েছিল। ২০০৬–এর নির্বাচনে তারা নিজস্ব লোক বসিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা চালায়।

জি এম কাদের যোগ করেন, ‘এর বিরুদ্ধে জনগণের যে আন্দোলন, আমরা তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলাম। বিএনপির অপশাসন থেকে মুক্তি পেতে আমরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট গঠন করেছিলাম।’

২০০৮ সালে ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন হয়েছিল দাবি করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আরও বলেন, ২০০৮ সালে মহাজোট বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু জনগণ আশাহত হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নতুন করে গুম, খুন যুক্ত হয়। জাতিকে আওয়ামী লীগ ও জনগণ—এই দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। এরপর ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করা হয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওই সংবিধানের অধীনে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। তখন ওনাকে চিকিৎসার নামে আটক করা হয়। জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা সারা দেশে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কয়েকজন ভয়–ভীতির কারণে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে পারেননি। পরবর্তীকালে তাঁদের নির্বাচিত দেখানো হয়েছে। তখন আমরা জনগণের আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করে নির্বাচন বর্জন করতে চেয়েছিলাম।’

২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর দলের চেয়ারম্যান হওয়া জি এম কাদের বলেন, ‘২০১৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি সবাই অংশগ্রহণ করে। আদর্শগত কারণে অস্তিত্বসংকটের আশঙ্কায় বিএনপির বদলে আমরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিলাম। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য থাকার পরও আমরা তাদের অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাদ করেছি। দেশের জনগণকে সুবিধাভোগী ও নির্যাতিত—এই দুই ভাগে ভাগ করার অপরাজনীতি আমরাই প্রথম তুলে ধরে এর বিরোধিতা করেছিলাম। ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সকল দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার ছিলাম।’

এর ফলে তাঁকে অন্যায়ভাবে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ করে জি এম কাদের বলেন, ‘আমরা তখনো জনগণের পক্ষে ছিলাম। ২০২৪-এ বিভিন্ন টালবাহানা করে আমাদের নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার অঙ্গীকার করেও নির্বাচনে তা রক্ষা করা হয়নি। আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচন হতো না বা নির্বাচন বৈধতা পেত না, এই রকম পরিস্থিতি ছিল না।’

বিগত সাতটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা ও অবস্থান তুলে ধরে দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত এইচ এম এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদের বলেন, এরশাদ সাহেব কখনো জনগণের কাছে নিন্দিত ছিলেন না। প্রতিটি নির্বাচনে তিনি যেখানে দাঁড়িয়েছেন, সেখানেই জয়লাভ করেছেন। সুতরাং এরশাদকে স্বৈরাচার অথবা পতিত স্বৈরাচার যাঁরা বলেন, তাঁরা হয় স্বৈরাচারের অর্থ বোঝেন না, অথবা গণতন্ত্রকে সম্মান করেন না। জনগণের ইচ্ছায় যে নেতা তৈরি হন অথবা যে নেতার কর্মকাণ্ডে জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়, তিনি কখনো স্বৈরাচার হতে পারেন না।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তন–উত্তর পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে জি এম কাদের বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় আমাদের নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে মামলার আসামি করা হচ্ছে, এটা মোটেই কাম্য নয়। আমরা জনগণের সঙ্গেই ছিলাম। জনগণ পরিবর্তন আশা করে বুকের রক্ত দিয়ে আওয়ামী সরকারকে উৎখাত করেছে। কতিপয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পথেই হাঁটছে, যা পরিবর্তনের জন্য মোটেই সুখকর নয়। জনগণ এটাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না।’

জাতীয় কৃষক পার্টির সভাপতি লিয়াকত হোসেন চাকলাদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, অতিরিক্ত মহাসচিব রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, মনিরুল ইসলাম, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা খলিলুর রহমানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সকালে ইরফান বীন তুরাব আলীর সভাপতিত্বে ও মুফতি ফিরোজ শাহের পরিচালনায় জাতীয় ওলামা পার্টির মতবিনিময় সভা হয়।