রওশন-জি এম কাদের ঐক্যে আবার ফাটল

রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের
রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের

জাতীয় পার্টির দুই শীর্ষ নেতা রওশন এরশাদ এবং জি এম কাদের এবার তাঁদের দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মদিন উদ্‌যাপন করেছেন পৃথক কর্মসূচির মাধ্যমে। এখন রমজানে তাঁরা ইফতার অনুষ্ঠানও আলাদাভাবে আয়োজন করছেন।

এই পৃথক অনুষ্ঠান ইঙ্গিত দিচ্ছে যে জ্যেষ্ঠ নেতা রওশন এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে ঘিরে জাপায় বিভাজনটা রয়েই গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিভাজন আরও দানা বাঁধতে পারে।

এবার প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মদিন উপলক্ষে চারটি অনুষ্ঠান করেছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। এর একটিতেও রওশন এরশাদ ছিলেন না। তিনি আলাদা অনুষ্ঠান করেন তাঁর গুলশানের বাসায়। জাপার দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, রওশন ও ছেলে সাদ এরশাদকে পৃথক অনুষ্ঠান না করে জন্মদিনের দলীয় আয়োজনে অংশ নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা যাননি।

‘উনি (রওশন এরশাদ) বিরোধীদলীয় নেতা। আমরা ওনাকে সম্মান করি। এখন ওনাকে বহিষ্কৃত কিছু লোক ঘিরে ধরে কী করল না করল, সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছেন।’
মো. মুজিবুল হক, জাপার মহাসচিব

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, যদিও এ মুহূর্তে দুজনের সম্পর্ক এতটা খারাপ নয়। আবার খুব যে ভালো, তা–ও নয়। রওশন চুপচাপ আছেন। জি এম কাদেরও খড়্গ কাটিয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

রওশন এরশাদ দীর্ঘ সময় বিদেশে চিকিৎসা শেষ গত বছরের নভেম্বরে দেশে ফেরেন। এরপর তাঁর সঙ্গে জি এম কাদেরের কয়েকবার দেখা হয়। তাঁদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে বলে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। এখন আবার দলের প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিন পালন এবং ইফতার অনুষ্ঠান তাঁরা আলাদাভাবে আয়োজন করছেন। এটি তাঁদের ঐক্যে ফাটল ধরার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন।

আলাদা ইফতার আয়োজনের ঘোষণা

এর মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ জানিয়েছেন, এই রমজানে কূটনীতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মানে ইফতারের আয়োজন করবেন তাঁর মা বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। গুলশানে বিরোধীদলীয় নেতার অস্থায়ী কার্যালয়ে ‘জাতীয় পার্টির’ এক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা জানান। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ২৭ মার্চ তাঁরা গুলশানের একটি মিলনায়তনে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করবেন।

‘একটি মহল কাউকে কাউকে ব্যবহার করতে চায়। হয়তো কেউ কেউ ব্যবহার হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। কিন্তু এই ব্যবহার হওয়াটা কতটা কার্যকর হবে, জানি না।’
জি এম কাদের, জাপার চেয়ারম্যান

জাপার দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, প্রতিবছর রমজানে কূটনীতিক ও বিশিষ্টজনদের সম্মানে দলীয়ভাবে ইফতার অনুষ্ঠান হয়। এবারও ২ এপ্রিল হোটেল র‌্যাডিসনে কূটনীতিকদের সম্মানে জাপার ইফতার অনুষ্ঠান আছে।

সেখানে মূল দলের বাইরে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের পৃথক ইফতার ও আলোচনা সভার আয়োজন নেতা-কর্মীদের ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদিও এরশাদ–পত্নী রওশন ও ভাই জি এম কাদেরের এ ভিন্ন অবস্থানের রহস্য যে কী, তা নিয়ে খোদ দলের ভেতরেই প্রশ্ন আছে। তবে নেতা-কর্মীদের অনেকে মনে করেন, একসময় এরশাদের বিপক্ষে রওশন যে অবস্থান নিয়েছিলেন, এখন তিনি একই অবস্থান নিচ্ছেন জি এম কাদেরের সঙ্গে।

এ বিষয়ে জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনি (রওশন এরশাদ) বিরোধীদলীয় নেতা। আমরা ওনাকে সম্মান করি। এখন ওনাকে বহিষ্কৃত কিছু লোক ঘিরে ধরে কী করল না করল, সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছেন।’

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, রওশন এরশাদের বর্তমান কর্মকাণ্ডে ইন্ধন জোগাচ্ছে দলের সাবেক এবং দলচ্যুত নেতাদের একটি অংশ। কিন্তু নেপথ্যে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন জাপার অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব ও রওশনের ছেলে রংপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাদ এরশাদ। গত সপ্তাহে এটি আরও প্রকাশ্য হয় রাজধানী ঢাকায় একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। সেখানে জি এম কাদের জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে শুভেচ্ছা জানাতে যান।

ওই অনুষ্ঠানে সাদও যান একদল ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে। যাঁদের অনেককে দলীয় পদ থেকে জি এম কাদের বাদ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কাজী মামুনুর রশীদ নামে একজন ছিলেন, যিনি কিছুদিন আগেও বিদিশা সিদ্দিকের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নামে নতুন দল করার চেষ্টা করেছেন।

এমনকি মুঠোফোনে জি এম কাদেরকে জীবননাশের হুমকিসংবলিত খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের এ ঘটনার পর এরশাদের পৃথক জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়। এরপর সামনে এসেছে পৃথক ইফতার অনুষ্ঠান।

দলের বাইরে পৃথক ইফতার অনুষ্ঠান কেন, এটি নেতা-কর্মীদের ভিন্ন বার্তা দেবে কি না, জানতে চাইলে সাদ এরশাদ বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। সাদ এরশাদ পাল্টা জানতে চান, বিরোধীদলীয় নেতা কি দাওয়াত দিতে পারেন না?

নির্বাচন প্রশ্নেই কি বিরোধ বাড়ছে এখন

জাপার নেতা-কর্মীদের অনেকের ধারণা, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে বিভাজন আরও বাড়তে পারে। সম্প্রতি রওশন এরশাদ জাপার কেন্দ্রীয় সম্মেলন আহ্বান করলে দলে বিভাজন দেখা দেয়।

দলের বহিষ্কৃত ও সাবেক কিছু নেতা রওশন এরশাদকে ঘিরে তৎপর রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন জি এম কাদেরের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেন। এরপর আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞায় তিন মাসের মতো জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত ছিলেন। তিনি আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন।

এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার জন্য রওশন এরশাদের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি। তাঁকে খুদে বার্তাও পাঠানো হয়। কিন্তু তারও কোনো জবাব তিনি দেননি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রওশন এরশাদ এবং জি এম কাদেরের বিরোধের কারণে জাপা এখনো ভেঙে যায়নি। কিন্তু দুই শীর্ষ নেতার বিরোধের প্রভাব পড়ছে দলের সব পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের ওপর।

জি এম কাদের চাইছেন দলের পথচলা হবে এক নীতিতে, ঐক্যবদ্ধভাবে। জি এম কাদের নীতিগতভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে কর্তৃত্ববাদী সরকার মনে করেন। তিনি মনে করেন না কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীন কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু এর বিপরীত অবস্থান রওশনের। তিনি অনেক আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে বর্তমান সরকারের অধীনেই জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে। তাঁর এ অবস্থান দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।

জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের মনে করেন, জাতীয় পার্টিকে দুর্বল করার জন্যই দলে এ বিভাজন সৃষ্টির প্রয়াস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি মহল কাউকে কাউকে ব্যবহার করতে চায়। হয়তো কেউ কেউ ব্যবহার হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। কিন্তু এই ব্যবহার হওয়াটা কতটা কার্যকর হবে, জানি না।’

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় পার্টির দুই শীর্ষ নেতা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন, ফলে দলের ওপর তাঁদের বিরোধের প্রভাব কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটা এখনই বলা মুশকিল।