খুলনায় ভোটের হার নিয়ে সন্দেহ–অবিশ্বাস

ফাঁকা ভোটকেন্দ্র। গত সোমবার সকাল পৌনে নয়টা, বয়রা পুলিশ লাইন স্কুল ভোটকেন্দ্র
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতির যে চিত্র নির্বাচন কমিশন তুলে ধরেছে, তা নিয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও উত্তাপহীন নির্বাচনে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়েনি। কিন্তু ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে ৪৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।

২০১৮ সালের খুলনা সিটির নির্বাচনের সঙ্গে এবারের ভোটের ফলাফলের তুলনা করলেও অস্বাভাবিক চিত্র পাওয়া যায়। গত নির্বাচনের থেকে এবার আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভোট কমেছে।

কিন্তু অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে অন্য প্রার্থীদের ভোট। এমনকী আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী গতবারের চেয়ে চারগুণের বেশি ভোট পেয়েছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থীর ভোট বেড়েছে ১৬ গুণেরও বেশি।

খুলনার বিভিন্ন দলের নেতা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও পরাজিত মেয়র প্রার্থীরাও এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বিএনপির কোনো প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। ফলে সোমবারের নির্বাচন ছিল একেবারে উত্তাপহীন। দিনভর ভোটের মাঠ ছিল একেবারে ফাঁকা। এমন পরিস্থিতিতে কোথা থেকে এতো ভোট পড়েছে, এটি তারা বুঝতে পারছেন না।

আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীরা বলছেন, তাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। ফলাফল ঘোষণায় তাঁদের পক্ষে যে ভোট দেখানো হয়েছে, সেটি তাঁদের প্রকৃত ভোট নয়। তাঁরা এমন অভিযোগও করছেন যে, ভোট পড়ার হার এবং নির্বাচনের ফলাফলে ‘কারসাজি’ করা হয়েছে।  

খুলনা নগরীর স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও ঘোষিত ফল নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, দল বেধে ভোটাররা কেন্দ্রে না গেলেও বলা হচ্ছে প্রায় ৪৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। বিএনপি মাঠে না থাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক জয়লাভ করবেন এটা ধারণায় ছিল। কিন্তু এতো বেশি ভোট পড়ার কথা নয়। ইভিএম যন্ত্র দিয়ে কোনো ম্যাকানিজম করা হয়েছে কি না এ নিয়েও তাদের সন্দেহ হচ্ছে।

অবশ্য এসব অভিযোগের বিষয়ে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দীন কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পরে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই অভিযোগ সত্য নয়। আমি বিশ্বাস করি না, এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে। যদি এমন কোনো অভিযোগ ওঠে তাহলে তা জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হবে। আমরা তা মোকাবিলা করব।’

ভোটের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের ভোট কমেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি ভোট পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮৫৪ ভোট। অর্থাৎ এই নির্বাচনে তাঁর ভোট কমেছে ২০ হাজার ২৬টি।

শুধু ভোট কমেছে আওয়ামী লীগের

গত সোমবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মেয়র পদে তালুকদার খালেক ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮২৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য চার প্রার্থীর কেউই তাঁর কাছাকাছি ভোট পাননি।

তবে ভোটের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের ভোট কমেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি ভোট পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮৫৪ ভোট। অর্থাৎ এই নির্বাচনে তাঁর ভোট কমেছে ২০ হাজার ২৬টি।

উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে অন্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে। গত নির্বাচনে (২০১৮) ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুজাম্মিল হক ভোট পেয়েছিলেন ১৪ হাজার ৩০৩টি। এবারের নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আবদুল আউয়াল ভোট পেয়েছেন ৬০ হাজার ৬৪টি। তিনি গতবারের চেয়ে চার দশমিক ১৮ গুণ ভোট বেশি পেয়েছেন।

ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান শেখ মো. নাসির উদ্দিন গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেছেন, ঘোষিত ভোটের ফল তাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।

এদিকে গত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে প্রার্থী হয়ে এস এম শফিকুর রহমান ভোট পেয়েছিলেন ১ হাজার ৭২টি। এবার তিনি স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করে ১৭ হাজার ২১৮ ভোট পেয়েছেন ।  তিনিও এত ভোট তাঁর নিজের নয় বলে দাবি করেন।

ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দিচ্ছেন ভোটার। গত সোমবার সকাল আটটার দিকে, বিকে ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন ভোটকেন্দ্র

এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শফিকুল ইসলাম ভোট পেয়েছেন ১৮ হাজার ৭৪টি। গত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন ১ হাজার ৭২ ভোট।  অর্থাৎ এবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী ১৬ দশমিক ৮৬ গুণ বেশি ভোট পেয়েছেন।

আরেক প্রার্থী জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী এস এম সাব্বির হোসেন ভোট পেয়েছেন ৬ হাজার ৯৬ ভোট পেয়েছেন। তাঁরও এতো ভোট পাওয়ার কথা নয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

বিএনপি কী ভোটারদের ঠেকাতে পেরেছে

দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তাই খুলনা সিটিতে আওয়ামী লীগের এবারে মূল প্রতিপক্ষ ছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে নেতা–কর্মীদের কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করেছিল বিএনপি। এরপরও খুলনা সিটির নির্বাচনে ৪৭ দশমিক৮৮ শতাংশ ভোট পড়ার পর কিছু মহলে প্রশ্ন উঠেছে দেখা দিয়েছে, বিএনপি কী আদৌ তাঁদের নেতা–কর্মীদের ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পেরেছে, নাকি তারাও কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন।

এ বিষয়ে কথা হয় গত নির্বাচনে খুলনা সিটিতে বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে বিএনপির নেতা–কর্মীরা যেন কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করে সে জন্য একটি পর্যবেক্ষক দল গঠন করা হয়েছিল। এ কারণে কোনো নেতা–কর্মীই ভোটকেন্দ্রে যাননি। হাতেগোনা কয়েকজন দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছিলেন। তাদের সমর্থনেও বিএনপির নেতা–কর্মীরা ভোট দিতে যাননি বলেই তাঁর ধারণা।

তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এই নির্বাচনে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতা–কর্মীদের একটি অংশ ভোট দিয়েছেন। এমনকি বিএনপির পাঁচজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছেন। একজন জামায়াতের প্রার্থীও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতের ভোটাররা ভোট দিয়েছেন। এই ভোটগুলো তারা নৌকায় দেননি। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অন্য মেয়র প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন।  

ভোটারকে সহযোগিতা করছেন নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা। গত সোমবার তিতুমীর স্কুল কেন্দ্রে

‘৩৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ার কথা না’

খুলনার সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি কুদরত-ই-খুদা প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা সিটির নির্বাচন ছিল নিরুত্তাপ। নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো আশা–আকাঙ্খা ছিল না। এমনকি তাঁদের মধ্যে কোনো আগ্রহও ছিল না। খোলা চোখে এখানে ৩৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ার কথা নয়। এখন ভোট বেশি পড়েছে। ইভিএম’র (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) কোনো কারণ থাকতে পারে। তবে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলছি না।

কুদরত–ই–খোদা আরও বলেন, গণতন্ত্রহীনতা, সাধারণ মানুষের নির্বাচন নিয়ে অনীহা, বিএনপির প্রার্থী না থাকা এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রার্থী না থাকার পরও অনেক ভোট পড়েছে। এর অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে।