নির্বাচন
নির্বাচন

উপজেলা নির্বাচন

দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে এমপিদের স্বজনেরা ভোটে

চার পর্বের ভোট

  • প্রথম পর্বের ভোট ৮ মে।

  • দ্বিতীয় পর্বের ভোট ২১ মে।

  • তৃতীয় পর্বের মনোনয়নপত্র জমা চলছে।

  • শেষ পর্বের তফসিল ঘোষণা হয়নি।

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান, নিকটাত্মীয় ও স্বজনেরা ভোটের মাঠে রয়ে গেছেন। গতকাল সোমবার প্রথম পর্বের ভোটের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে মাত্র তিনজন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজন সরে দাঁড়িয়েছেন। আরও ২০ জনের বেশি স্বজন উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ভোটের লড়াইয়ে থেকে গেছেন। এখন পর্যন্ত মন্ত্রী-এমপিদের দুই স্বজনসহ সাতজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধান অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দ্বিতীয় পর্বে নতুন করে আরও প্রায় ৩৫ জন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের স্বজন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। চেয়ারম্যান পদে দলীয় সিদ্ধান্ত না মানায় ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের বসাতে কোনো চেষ্টাই করেনি আওয়ামী লীগ।

প্রথম পর্বের ভোট ৮ মে। গতকাল সোমবার ছিল প্রথম পর্বের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। অন্যদিকে দ্বিতীয় পর্বের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা শেষ হয়েছে গত রোববার। এই পর্বের ভোট হবে ২১ মে। চার পর্বের উপজেলা ভোটের তৃতীয় পর্বের মনোনয়নপত্র জমা চলছে। শেষ পর্বের এখনো তফসিল ঘোষণা হয়নি।

১৮ এপ্রিল দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী সারা দেশে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকেরা গত এক সপ্তাহ ফোনে তাগাদা দেন তাঁদের। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বিবৃতি দিয়ে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান।

সরে দাঁড়ালেন তিনজন

এর মধ্যে গত রোববার নাটোরের সিংড়ায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবিব ভোট থেকে সরে দাঁড়ান। গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগারের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে সহিদুল ইসলাম। সরে দাঁড়ান নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী আয়েশা ফেরদৌস। তবে তিনি চেয়ারম্যান পদে ‘ডামি’ প্রার্থী ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। তাঁদের ছেলে আশিক আলী প্রার্থী রয়ে গেছেন। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে।

দলের সিদ্ধান্ত মানেননি যাঁরা

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মাদারীপুর সদরে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী রয়ে গেছেন সংসদ সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক চৌধুরী, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন এবং সোনাতলা উপজেলায় সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামান।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আলীর ছোট ছেলে আলী আফসার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। মোহাম্মদ আলী ও সফিকুল ইসলাম বর্তমান সংসদ সদস্য মাজহারুল ইসলামের চাচা। আর আলী আফসার মাজহারুল ইসলামের চাচাতো ভাই।

কুষ্টিয়া পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। তিনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই।

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ সদস্য আবদুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই হারুন অর রশীদও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেনি।

গত ২৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই সুযোগে দেশে অনেক জায়গায় মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা নিজের সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের চেয়ারম্যান পদে দাঁড় করিয়ে দেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা জানতে পারেন, কোথাও কোথাও মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা স্বজনকে প্রার্থী না করলেও নিজের পছন্দের (মাই ম্যান) প্রার্থী করেন। এতে তৃণমূলে বিভেদ সৃষ্টি এবং ভারসাম্য হারানোর আশঙ্কা করেন নীতিনির্ধারকেরা। এরপরই তাঁদের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বহিষ্কার, অতঃপর ক্ষমা

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে বহুবার দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়া নেতাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দুবার ক্ষমা করার নজির আছে। বিগত সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন দল স্থানীয় নির্বাচনে প্রতীক তুলে দিয়ে আবার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চাইছে। অর্থাৎ একেক সময় একেক অবস্থান নিয়েছে দল। ফলে কেউ দলের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কারণ, তাঁদের ধারণা ক্ষমা পেয়ে যাবেন।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে, যেকোনো নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ প্রার্থী হলে সরাসরি বহিষ্কার হবেন। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শাস্তি না দিয়ে বরং পরে দলে টেনে নেওয়া হয়েছে। এখন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া কতটা সম্ভব হবে, এ বিষয়ে সন্দিহান আওয়ামী লীগের নেতারা। ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক রয়েছে। ওই বৈঠকে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হতে পারে। সে পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই বলে মনে করছেন দলের দায়িত্বশীল নেতারা।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করলে কী হতে পারে, তা নিশ্চয়ই মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা বোঝেন। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী

আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের যে বৈঠকে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। এরপরও প্রথম পর্বে সাতজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় পর্বে তিন উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের একজন করে প্রার্থী হয়েছেন। তাঁরাও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে। দ্বিতীয় পর্বে মনোনয়ন প্রত্যাহারের এখনো সময় আছে। ফলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

প্রথম পর্বে একক প্রার্থী হিসেবে বাগেরহাট সদর, মুন্সিগঞ্জ সদর, নোয়াখালীর হাতিয়া, মাদারীপুরের শিবচর, নাটোরের সিংড়া, ফেনীর পরশুরাম ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় আওয়ামী লীগের একজন করে ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থী নেই। ফলে তাঁরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই জয়ী হওয়ার পথে। এর মধ্যে মুন্সিগঞ্জ সদরে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফয়সালের চাচা আনিস উজ্জামান এবং হাতিয়ায় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশিক আলী রয়েছেন। বাগেরহাট সদরে সরদার নাসির উদ্দিন এবং শিবচরে সেলিম মিয়া গত নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন।

রোয়াংছড়িতে চারজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে তিনজন গতকাল প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। এখন এই উপজেলায় একমাত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী আওয়ামী লীগের চহ্লামং মারমা। প্রত্যাহার করা তিনজনের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান চহাইমং মারমাসহ আওয়ামী লীগের দুজন ও সাবেক জেএসএস নেতা একজন।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগ ওঠার পর নাটোরে সিংড়া উপজেলা নির্বাচনে গত রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক লুৎফুল হাবীব। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী দেলোয়ার হোসেনকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছিল। এখন সেই দেলোয়ারই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে।

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে কুমিল্লা সদর, চট্টগ্রামের রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া—এই তিন উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে একজন করে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ফলে তাঁদের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষিত হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হবেন। যাচাই-বাছাইয়ে কিছু প্রার্থী বাতিল হতে পারেন। আবার ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সুযোগ আছে। এতে আরও কিছু উপজেলায় একক প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দ্বিতীয় পর্বে চট্টগ্রামের রাউজানে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে একজন করে প্রার্থী হয়েছেন। এই উপজেলায় স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বরাবরই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার নজির রয়েছে।

রাঙ্গুনিয়ার বর্তমান চেয়ারম্যান স্বজন কুমার তালুকদার ২০২০ সালে উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন। এবার তাঁকে বাদ দিয়ে চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম চিশতিকে।

কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা পরিষদেও চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে একজন করে প্রার্থী। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম। তিনি গত নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।

গত মাসে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানও তাঁর ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত। অর্থাৎ এর মাধ্যমে কুমিল্লা সদরে সংসদ সদস্য নিজের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

বিরোধীদের বর্জনের কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি কম দেখা যায়। ২০১৪ সালে বিরোধী দলবিহীন জাতীয় নির্বাচনে ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হলে দেশে-বিদেশে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ জন্য যেকোনো ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার জয় ঠেকাতে তৎপর আওয়ামী লীগ।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]