শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়ে ‘অপপ্রচারের’ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের (বাঁয়ে) ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম
ফাইল ছবি

জাতিসংঘের অধীনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর বিষয়টি এখন আবার আলোচনায় এসেছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তৎপরতায় দেশের মানবাধিকার নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ থেকে নিয়োগের ক্ষেত্রে মানবাধিকারের বিষয় যাচাই–বাছাই করার দাবি করেছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ অভিযোগ করেছে, এর পেছনে বিরোধী দল বিএনপির হাত রয়েছে।

ক্ষমতাসীন দলটি এমন অভিযোগও করেছে যে এ ধরনের তৎপরতায় দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালকে (টিআই) ব্যবহার করছে বিএনপি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমন অভিযোগ করেন। সোমবার আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এখন পরিষ্কারভাবে যেটা দেখতে পাচ্ছি, তারা (বিএনপি) লবিস্ট নিয়োগ করেছে। আমেরিকা, ইউরোপে তারা লবিস্ট নিয়োগ করেছে। সর্বশেষ যে খবর পেয়েছি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অপপ্রচারের সঙ্গে তাদের অপপ্রচার একাকার হয়ে গেছে।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ‘তারা (বিএনপি) অবশেষে, বাংলাদেশের যে বিষয়টি বাইরে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে দেখা হয়, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী। আমাদের সেনাবাহিনী দেশে দেশে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত, তাদের সেই মিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালকে কাজে লাগাচ্ছে।’

অবশ্য বিরোধী দল বিএনপি ওবায়দুল কাদেরের অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। দলটি বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে আছে। বিএনপি বলছে, আন্তর্জাতিকভাবে যা হচ্ছে, এর পেছনে সরকারই দায়ী।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরাম থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, এর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্কে নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনা—এগুলোই সমস্যা তৈরি করেছে। তিনি আরও বলেন, সরকারের দায়িত্বহীন ও গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, কংগ্রেসম্যানদের বক্তব্য, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সমালোচনা বা বক্তব্য আসছে। এর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্কই নেই। এ পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী।

২০০৬ সালে যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতি উত্তাল হয়ে ওঠে, তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে নামে। একপর্যায়ে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর মিশনে সুযোগ পাওয়ার বিষয়টিও আলোচিত হয়। এরপর এক-এগারোর সরকার দায়িত্ব নিয়ে প্রায় দুই বছর পর নির্বাচন হয়। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠিত হয়। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ জয় পায় আওয়ামী লীগ। দুটি নির্বাচন নিয়েই দেশে-বিদেশে বিতর্ক আছে।

আরেকটি নির্বাচন সামনে রেখে ১২ জুন জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিষয় যাচাই-বাছাইয়ের আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জাঁ পিয়ের লাক্রোয়ার প্রতি এ আহ্বান জানায় সংগঠনটি। জাতিসংঘের এই কর্মকর্তার ২৫ জুন দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসার কথা রয়েছে।

এইচআরডব্লিউ এ বিষয়ে বলেছে, জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদান সবচেয়ে বেশি। এ অবস্থান ধরে রাখতে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই নীতিমালা যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, জাতিসংঘের হয়ে কাজ করা তাদের কোনো নাগরিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত নয়। সফরকালে জাঁ পিয়ের লাক্রোয়াকে এই নীতিমালার ওপর জোর দিতে হবে।

একই দিন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলকে একটি চিঠি লেখেন। এতে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ, চলমান সংকটের টেকসই ও গণতান্ত্রিক সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনার কথা বলা হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে আহ্বান জানান তাঁরা।

৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ছয়জন কংগ্রেস সদস্য বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা চেয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের কাছে চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে কংগ্রেস সদস্যরা বলেন, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসায় মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে। এটি নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জবাবদিহি নিশ্চিতে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও অন্যান্য সংস্থার প্রতি অনুরোধ জানান তাঁরা। এর আগে আরও ছয়জন কংগ্রেস সদস্য একই রকম বক্তব্য দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চিঠি লেখেন।

এর আগে গত ২৪ মে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র।

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালে বাংলাদেশ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও বাহিনীর তৎকালীন বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেই পটভূমিতে দেশে ক্রসফায়ার বা বিনা বিচারে হত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। এর পর থেকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের অন্য ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে কি না, সেই আলোচনা চলতে থাকে। সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, মার্কিন কংগ্রেসম্যান ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের তৎপরতা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কড়া অবস্থান—নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা আলোচনা রয়েছে।

শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, সে বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কোনো দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে ব্যবহৃত হয় না। এখানে সংস্থাটিকে ঘিরে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তা অমূলক। একই সঙ্গে তিনি বলেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা টিআইবি কখনো কোনো কাজ করে না। ফলে এ ব্যাপারে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা একেবারেই ভিত্তিহীন।