সাধারণ সৈনিকেরা গুলি করতে অস্বীকার করেছিল বলে এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। ফলে সৈনিকদের অভিপ্রায়, যারা শ্রমিকের সন্তান, যারা কৃষকের সন্তান তাদের অভিপ্রায়ের সঙ্গে আমরা এখানে যারা একত্র হয়েছি, আমাদের অভিপ্রায়ের কোনো পার্থক্য নেই। আজ শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছেন কবি ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার। তিনি গণ–অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় অনুযায়ী গঠনতন্ত্র চালু করতে বলেছেন।
সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘দুর্নীতি ও রাষ্ট্রপতি বা সংস্কার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথাগুলো বলেন ফরহাদ মজহার। সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজ এ বৈঠকের আয়োজন করে।
ফরহাদ মজহার বলেন, সংবিধান শব্দটি পরিবর্তন করতে হবে। এটি ঔপনিবেশিক শব্দ। ব্রিটিশ শাসকেরা সংবিধান নামে আইন চাপিয়ে দিয়ে শাসন চালাত; কিন্তু গণতন্ত্রে শাসনের অস্তিত্ব নেই। সংবিধানের আভিধানিক অর্থ হবে গঠনতন্ত্র। জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে জনগণের রাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায়ই ব্যক্ত হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব নতুন একটি গঠনতন্ত্র উপহার দেওয়া বলে মন্তব্য করেন ফরহাদ মজহার। এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, জনগণের অভিপ্রায়ের মধ্য দিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। নতুন গঠনতন্ত্রে জনগণের অভিপ্রায়কে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই গঠনতন্ত্র বৃহৎ হতে হবে এমন নয়। এটি মাত্র ১৬ পাতারও হতে পারে। রাষ্ট্র কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না, জনগণকে কী ক্ষমতা দেওয়া হলো আর রাষ্ট্রকে কী ক্ষমতা দেওয়া হলো—সেই বিষয়গুলো গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট করে লিখিত থাকবে। রাষ্ট্র জনগণের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করবে। ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ করতে পারবে না।
ফরহাদ মহজার বলেন, ‘এই যে সরকার, যেটা সেনা–সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার। আপনারা অনেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলছেন, এটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, এটা সেনা–সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার। এই সরকার টিকে আছে, যেহেতু এখনো পর্যন্ত আমাদের সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান তিনি ভালো মানুষ, তিনি সাপোর্ট করে যাচ্ছেন। তিনি যদি সমর্থন না করেন এই সরকার পড়ে যাবে। তাঁর শুভবুদ্ধির ওপর ভিত্তি করে এটা দাঁড়িয়ে আছে। ফলে সেনা–সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার আছে, আমরা সেনা–সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার চাই না। আমাদের সৈনিকেরাও চায় না। সাধারণ সৈনিকেরা গুলি করতে অস্বীকার করেছিল বলে এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। ফলে সৈনিকদের অভিপ্রায়, যারা শ্রমিকের সন্তান, যারা কৃষকের সন্তান তাদের অভিপ্রায়ের সঙ্গে আমরা এখানে যারা একত্র হয়েছি, আমাদের অভিপ্রায়ের কোনো পার্থক্য নেই।’
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সারা বিশ্বের কাছে অবৈধ উল্লেখ করে ফরহাদ মহজার বলেন, ‘অভিযোগ উঠতে পারে, অবৈধভাবে শেখ হাসিনাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই এই সংবিধানের অধীন আমরা অন্তর্বর্তী সরকার চাই না। এই সংবিধান আমাদের জন্য বিপজ্জনক। এই সংবিধান দিল্লি এবং ইন্দো-আমেরিকান-ইসরায়েলের আগ্রাসন থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। সুতরাং অবিলম্বে এই সংবিধান বাতিল করে, সেনাবাহিনী–সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণা থেকে বের হয়ে এসে পরিপূর্ণ স্বাধীন সরকার হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। সেই সরকারের প্রতি আমাদের সমর্থন সহযোগিতা পরিপূর্ণভাবে থাকবে।’
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সর্বজনীন আদর্শের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করা; কিন্তু তা করা হয়নি। ভাষা, ধর্ম, বর্ণ যেকোনো জাতীয়তাবাদভিত্তিক রাষ্ট্র উগ্রতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধের সৃষ্টি করে। ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ওই সর্বজনীন আদর্শের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক জাতিগোষ্ঠী ও সমাজ গঠন করতে চাই। যেখানে প্রত্যেকে বিশ্বাস, আদর্শ ও শ্রেণি–পেশার মানুষ তাদের নিজস্ব অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে। স্বাধীন রাজনৈতিক জাতিগোষ্ঠীর বোধ যতক্ষণ না জনগণের চেতনায় আসবে, ততক্ষণ জনগণের প্রকৃত বিজয় অর্জন সম্ভব হবে না।’
বড় দল হিসেবে বিএনপিকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে বলে মন্তব্য করেন ফরহাদ মজহার। বিএনপি কেন এই রাষ্ট্রপতিকে রাখতে চায়, তা বোধগম্য নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। ফরহাদ মজহার বলেন, রাষ্ট্রপতি যখন বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র তাঁর কাছে নেই, তখন থেকেই তাঁর আর ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার নেই। এই সরকার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এসেছে। সেটিই তাদের সবচেয়ে বড় বৈধতা, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার দায় তাদের নেই। তারা রাষ্ট্রপতিকে বিদায় দেওয়ার ঘোষণা দিতে পারে। অধ্যাদেশ নয় ঘোষণা দিতে হবে। এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, সামরিক সরকার যদি অধ্যাদেশ জারি করে সরকার চালাতে পারে, তবে গণ-অভ্যুত্থানে গঠিত সরকারও ঘোষণা দিয়ে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে এবং সেটি বৈধ বলে গণ্য হবে। এই বৈধতার আইনি ভিত্তি রয়েছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহার বলেন, আগে গঠনতন্ত্র তৈরি করতে হবে। সর্বস্তরের জনগণের অভিপ্রায় অনুসারে গঠনতন্ত্র সম্পর্কে গণপরিষদ নির্বাচন করতে হবে। এরপর হবে সরকার গঠনের নির্বাচন।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে গণমুক্তি জোটের চেয়ারম্যান ড. শাহরিয়ার ইফতেখার বলেন, বিলম্ব হলেও এখনো বিপ্লবী সরকার গঠনের সুযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রপতির উচিত আত্মসম্মান রক্ষার্থে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা। দেশের ১৬ কোটির মধ্যে ১২ কোটি মানুষ তাঁর বিপক্ষে। বিপ্লবী সরকার গঠিত হবে। এরপর শুধু বড় দল নয়, সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।
সাবেক সচিব কাশেম মাসুদ বলেন, ‘এখন আমরা একটি অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে আছি। সবাই মিলে জনমত তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের আগে আমূল সংস্কার করতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন করতে হবে।’
গণ-আজাদী লীগের একাংশের সভাপতি আতাউল্লাহ খান বলেন, যে সংবিধানের দোহাই দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪–এর অবৈধ নির্বাচন করেছে, সেই সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার দায় অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। জনগণ যে সংস্কারের জন্য গণ-অভ্যুত্থান করেছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতায় রেখে সেই সংস্কার করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ কংগ্রেসের মহাসচিব ইয়ারুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক সরকার তাদের সুবিধামতো সংস্কার করে থাকে। কাজেই রাজনৈতিক সরকার যে বিষয়গুলো সংস্কার করবে না, দেশ ও জনগণের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারকে সেই বিষয়গুলোর সংস্কার করতে হবে।
জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সম্পাদক গোবিন্দ প্রামাণিক বলেন, রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দেশের এক নম্বর ব্যক্তির বিরুদ্ধেই যদি দুর্নীতির অভিযোগ আসে, তবে তাঁকে ক্ষমতায় রেখে দুর্নীতি দমন করা কীভাবে সম্ভব?
জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম মজুমদার বলেন, রাষ্ট্রপতিই এখন সংস্কারের পথে প্রধান বাধা। রাষ্ট্রপতির সংস্কারই হচ্ছে প্রধান সংস্কার। একই সঙ্গে প্রশাসনের সব দুর্নীতিবাজকে অপসারণ করতে হবে।
গণ অধিকার পরিষদের নেতা মাহবুবুল বারী চৌধুরী বলেন, ‘বাঙালি দুর্নীতিতে একাধিকবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের রেকর্ড করেছে। দুর্নীতিকে আমরা দুর্নীতি বলে মনে করি না। সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি নিজেদেরও সংস্কার প্রয়োজন।’
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন শিক্ষাবিদ মোমেনা খাতুন, অধ্যাপক ঈসা মোহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাইফুল আলম, প্রাবন্ধিক মেহেদি হাসান, প্রকৌশলী আল মামুন, রাজনীতিক মমতাজ উদ্দিন আহমদ, মাসুদুর রহমানসহ অনেকে। সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সাদেক রহমান।