জাতীয় পার্টির খণ্ডিত কয়েকটি অংশকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছেন রওশন এরশাদপন্থী কয়েকজন নেতা। তাঁরা ‘জাতীয় পার্টির ঐক্য’ গড়তে ইতিমধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি থেকে বাদ পড়া রওশনপন্থী নেতাদের মূল লক্ষ্য, জি এম কাদেরের ওপর অভ্যন্তরীণ চাপ সৃষ্টি করা এবং পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে থাকা।
যদিও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সেভাবে সাড়া পাওয়া যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
এই উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপাতত তাঁদের লক্ষ্য রওশনপন্থী অংশটির সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (এম এ মতিন), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিকে (বিজেপি) একত্র করা। এ ছাড়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকেও (জেপি) ঐক্যপ্রক্রিয়ায় যুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে। শুধু জি এম কাদেরকে বাদ দিয়ে তাঁর দলের অন্য নেতাদের এই উদ্যোগে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হবে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে রওশনপন্থী নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন, কাজী মামুনুর রশীদসহ অনেকে যুক্ত রয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে গত সোমবার জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের সঙ্গে কথা বলেছেন রওশনপন্থী জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার মিলন।
মোস্তফা জামাল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐক্য জিনিসটা তো ভালো। তবে জাতীয় পার্টির ঐক্য খুব কঠিন কাজ। আমি বলেছি, যদি পারো করো।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, জাতীয় পার্টির খণ্ডিত অংশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চলছে রওশন এরশাদের সম্মতি নিয়ে। রওশন ইতিপূর্বে একাধিকবার বলেছেন, মৃত্যুর আগে তিনি পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ দেখতে চান। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রওশন এরশাদ, তাঁর ছেলে সাদ এরশাদসহ অনুসারী সব নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে।
এ অবস্থায় জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরুর দায়িত্ব নেন কয়েকজন নেতা। তাঁদের অন্যতম গোলাম সারোয়ার মিলন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খণ্ডিত-বিভক্ত জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি গণতান্ত্রিক শক্তিশালী জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এটা তারই একটি প্রয়াস।’
যদিও জাতীয় পার্টির রওশনপন্থীদের ঐক্যের উদ্যোগের বিষয়ে কাজী জাফরের জাতীয় পার্টির অন্য নেতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। তাঁরা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সময়েও রওশন এরশাদ আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আগুনে ভস্মীভূত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী টোল প্লাজায় গিয়ে তিনি ছাত্রদের দোষারোপ করেন। এ সময় রওশনের সঙ্গে তাঁর দলের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদও গণমাধ্যমে ছাত্রদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বক্তব্য দেন। ফলে রওশন এরশাদসহ তাঁর অনুসারী এসব নেতা পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রকৃত দোসর ছিলেন। এ ছাড়া কাজী জাফরের জাতীয় পার্টি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল। এখন যুগপৎ আন্দোলনে আছে। তারা এখন রওশন এরশাদের অনুসারীদের সঙ্গে ঐক্য গড়লে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
বিভক্ত জাতীয় পার্টির ঐক্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জেল-জুলুমের শিকার হয়ে রাজনীতিতে আছি। এখন পচা দোসরদের সঙ্গে আমি কেন যাব? বরং তাদের কেউ আমার দলে আসতে চাইলে নেব কি না, চিন্তা করব।’
রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল থেকে নেতাদের ভাগিয়ে জাতীয় পার্টি গঠন করেছিলেন। সেটি ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি। সেই জাতীয় পার্টির নামে এখন মাঠে সক্রিয় আছে ছয়টি দল। এর মধ্যে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা), আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (জেপি), নাজিউর রহমান মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (বিজেপি), এম এ মতিনের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। কাজী জাফরের জাতীয় পার্টি ও রওশনের জাতীয় পার্টির নিবন্ধন নেই।
জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু ঐক্যের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাকে মূল দলে ঢোকার ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না খণ্ডিত অংশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চিন্তা থেকে এটা হচ্ছে। কারণ, আমার কাছে প্রস্তাব এসেছে, তাঁদের কয়েকজন পার্টিতে আসতে চান, আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু কারও কারও ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে, আমরা তাঁদের নিতে পারব না।’
মুজিবুল হক আরও বলেন, ‘আমি যতটুকু বুঝি, যাঁরা দলে আসতে চান, এর ক্ষেত্র তৈরি করার জন্যই এই ঐক্যপ্রক্রিয়া। এটা একধরনের চাপ তৈরি চেষ্টা আরকি!’